State News

‘আমার বর্তিকায় লেখো’! রিকশাওয়ালা মদন সেই থেকে লেখক হয়ে গেলাম

তাপদগ্ধ এক দুপুর। আমার রিকশায় সওয়ারি হয়েছিলেন। এমন তো জীবনে উনি কতবার কত রিকশায় চড়েছেন। ওঁকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, জিজীবিষা কথার মানে কী? উনি শিক্ষিকা। এমন কত-শত প্রশ্নের উত্তর রোজই দিয়ে থাকেন। বলেছিলেন, বেঁচে থাকার ইচ্ছা বা বাঁচিবার ইচ্ছা।

Advertisement

মনোরঞ্জন ব্যাপারী

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৬ ১৫:১৫
Share:

একটা বড় কঠিন সময়ে চলে গেলেন মহাশ্বেতা দেবী। জীবনের এই নিয়ম, একদিন যেতেই হয়। কিন্তু এক একজন মানুষের চলে যাওয়া সমাজ জীবনে যে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করে সে শূন্যতা আর পূরণ করা যায় না। আজ সারা দেশ জুড়ে শোনা যাচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর অশুভ শক্তির জয়ধ্বনি। প্রবল বেগে যে ধেয়ে আসছে দেশটাকে এক রক্তপ্লাবী বন্যায় ডুবিয়ে দেওয়ার কুত্‌সিত অভিশাপ নিয়ে। যেন সেই প্লাবনে- জহ্লাদের উল্লাস গর্জনের নীচে চাপা পড়ে যায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা, সম্মান, স্বাধীনতার সবকটি প্রশ্ন। দিকে দিকে দলিত অধিবাসী আর মুসলমান মানুষদের উপর শুরু হয়েছে বর্বর আক্রমণ। যে কোনও ছুতোয় তারা হামলে পড়েছে। নির্মম অত্যাচার চলছে নিরীহ নিম্নবর্গদের উপর। মানুষ এখন বিপন্ন। মানুষ এখন বড় অসহায়। এই সময় মহাশ্বেতা দেবীর বড় দরকার ছিল। দরকার ছিল তাঁর সাহসী, শক্তিশালী, ধারালো তলোয়ারের মতো সচল লেখনীর। সূর্য সমান অনল, অমল, অর্নিবাণ ক্রোধ নিয়ে যিনি আজীবন অসম সাহসী অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গিয়েছেন। সেই সত্তর দশকের ভয়ঙ্কর দিন থেকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই— মহাশ্বেতা দেবীর অগ্নিবর্ষী কলম কামানের নলের মতো গোলা দেগেছে মানব সভ্যতার শত্রুদের দিকে। কোনও প্রলোভনে বিকোন নি। কোনও ভয়ে নত হননি। অতন্দ্র প্রহরীর মতো অটল দাঁড়িয়ে ছিলেন রণাঙ্গনে। যা অন্যায়, যা অনুচিত, যা অমানবিক তার বিরুদ্ধে। আদিবাসী, বনবাসী, দরিদ্র, দলিত, শ্রমজীবী মানুষের ন্যায়-সংগ্রামের পক্ষে।

Advertisement

আজ আবার এক মহা লড়াই আসন্ন। কোনও ভাবেই পরিত্রাণ নেই। মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। উদ্যত অস্ত্রের সামনে প্রতিরোধের তর্জনী তুলে বলতে হবে থামো, আর এগিয়ো না। সেই দিনে আমাদের মহাশ্বেতা দেবীর জীবন এবং কর্ম, আর আগুনের বর্ণমালায় রচনা করে রেখে যাওয়া সুবিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার সাহস জোগাবে, পথপ্রদর্শক হবে।

আরও খবর- শ্রীমহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬-২০১৬)

Advertisement

মহাশ্বেতা দেবীর প্রয়াণে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আন্দোলন হারিয়েছে তার এক অনমনীয়, আপোষহীন সেনাপতিকে। আর আমি ব্যক্তিগত ভাবে হারিয়েছি তাঁকে, আমাকে যিনি নবজন্ম দিয়েছেন। বুঝিয়েছেন জিজীবিষা শব্দের সঠিক অর্থ। সেই মাকে। বিশাল এক মহীরূহের মতো ব্যাপ্ত হয়েছিলেন তিনি আমার জীবনে। সে এমন বৃক্ষ, শ্রান্ত হলে যার ছায়ায় গিয়ে কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যায়। কোনও মন্দির, মসজিদ, তীর্থস্থানে কোনও দিন যাইনি আমি। সময় সুযোগ পেলে ছুটে গিয়েছি ওঁর কাছে। আর পায়ের কাছে বসে একলব্য একাগ্রতায় পাঠ নিয়েছি জিজীবিষার। ধীরে ধীরে আমি সঞ্জীবন সান্নিধ্যে জেনেছি বেঁচে থাকা কাকে বলে।

সেটা ছিল ১৯৮১ সালের তাপদগ্ধ এক দুপুর। সে দিন প্রথম ওঁর দেখা পেয়েছিলাম আমি। আমার রিকশায় সওয়ারি হয়েছিলেন। এমন তো জীবনে উনি কতবার কত রিকশায় চড়েছেন। ওঁকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, জিজীবিষা কথার মানে কী? উনি শিক্ষিকা। এমন কত-শত প্রশ্নের উত্তর রোজই দিয়ে থাকেন। বলেছিলেন, বেঁচে থাকার ইচ্ছা বা বাঁচিবার ইচ্ছা। তার পর ওঁর কিছু প্রশ্ন আসে আমার দিকে। আর শেষে প্রস্তাব- আমার একটা পত্রিকা আছে, ‘বর্তিকা’। তাতে তোমার মতো মানুষরাই লেখে। তুমি লিখবে? এটাও ওঁর কাছে কোনও বড় ব্যাপার ছিল না। কারণ ওই পত্রিকায় আমার মতো বহুজন লিখেছে। ভুলভাল বানানে, অসম্পূর্ণ বাক্যে, এলোমেলো শব্দে- কিন্তু অতি সাধারণ মানুষের সে লেখায় নির্মম সত্য ছিল। সেই তাঁদের জীবনের প্রথম আর শেষ লেখা। তার পর আর কারও খবর নেই।

আরও পড়ুন- সব মরণ নয় সমান

তবে আমার ক্ষেত্রে এটা হয়নি। সেই যে আমার একটা লেখা ছাপা হল তার পর থেকে যেন নেশা ধরে গেল আমার। লিখতে হবে, আরও লিখতে হবে। জিজীবিষা শুধু শব্দে নয়, জীবনের ক্ষেত্রেও সত্য করতে হবে। দীর্ঘ ৩৪-৩৫ বছরের কঠিন লড়াইয়ের পর আজ মনে হয় সামনে আর মাত্র এক পা। তার পরই পৌঁছে যাব সেই লক্ষ্যে। যেখানে পৌঁছে বলা যায়— হ্যাঁ, আমি পেরেছি।

আট বছর ছত্তিশগড়ে ছিলাম। তখন আর বাংলায় আসা হয়নি। যাওয়া হয়নি ওঁর বাড়ি। বলা হয়নি নিজের কোনও কথা। তার পর যখন আমার ‘চণ্ডাল জীবন’ বই বের হল হুলুস্থুল পড়ে গেল পাঠক সমাজে তখন একদিন প্রণাম করে একটা বই দিতে গেলাম। সে দিন ওঁর দু’চোখে দেখেছিলাম অপূর্ব মাতৃস্নেহ। জড়িয়ে ধরে আমার মাথায় দিয়েছিলেন তিনটে চুমু। বলেছিলেন, তুই যে এত লম্বা রেসের ঘোড়া আগে জানতাম না।

আরও খবর- মহাশ্বেতা-স্মরণে: হাইলাকান্দি আপনার স্মৃতিচারণায় গর্বিত

আজ এত বছর পর সব হিসেবনিকেশের শেষে মনে হয়, মহাশ্বেতা দেবী আমার কাছে ছিলেন এক দেবধাম। বহু দুর্গম পথ পার হয়ে, বহু কষ্ট সয়ে ভক্ত যেমন দেবস্থানে গিয়ে প্রণাম করে, একটা মানসিক শক্তি পায়, আমিও ওঁর কাছে গিয়ে সেই শক্তি পেতাম।

আমার সেই পরম শক্তিকেন্দ্রটা আর রইল না। যেন সব হারিয়ে আমি অনাথ সর্বহারা হয়ে গিয়েছি।

আরও খবর- স্মৃতির পাতায় মহাশ্বেতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement