Advertisement
১১ মে ২০২৪
State news

সব মরণ নয় সমান

মহাশ্বেতা দেবীর জীবনবোধের মূল কথাই ছিল পরাজয় স্বীকার না করা। এবার পরাজিত হতেই হল। মৃত্যুর সঙ্গে প্রায় আড়াই মাসের লড়াই শেষ হল। বহু বছর আগে থেকেই দেখেছি হাসতে হাসতে নিজের শরীরে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দিতে, যেটা রক্তবাহী শিরায় প্রবিষ্ট করাতে হয়। তারপর ‘ও কিছু না ও কিছু না’ বলে রসগোল্লা খেয়েছেন।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

স্বপ্নময় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৬ ১৪:৩৯
Share: Save:

মহাশ্বেতা দেবীর জীবনবোধের মূল কথাই ছিল পরাজয় স্বীকার না করা। এবার পরাজিত হতেই হল। মৃত্যুর সঙ্গে প্রায় আড়াই মাসের লড়াই শেষ হল। বহু বছর আগে থেকেই দেখেছি হাসতে হাসতে নিজের শরীরে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দিতে, যেটা রক্তবাহী শিরায় প্রবিষ্ট করাতে হয়। তারপর ‘ও কিছু না ও কিছু না’ বলে রসগোল্লা খেয়েছেন। তারপর গোটা ছয়েক ট্যাবলেট মুখে নিয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে বললেন, কাল বাঁকুড়া ছুটতে হবে। রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন বহু দিন ধরেই, আসলে যুদ্ধ করতে হয়েছে একেবারে ছোটবেলা থেকে। একের পর এক যুদ্ধ। সচ্ছল পরিবারেই বড় হয়েছিলেন, কিন্তু যৌবনের প্রথমেই সচ্ছল জীবন ছেড়ে বেছে নিলেন একটা সংগ্রামী জীবন। গণনাট্য আন্দোলনের অগ্রদূত বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে সাংসারিক গাঁটছড়া বাঁধলেন।

বিজন ভট্টাচার্যের নির্দিষ্ট রোজগার ছিল না। সেলস গার্ল-এর কাজ করেছেন, ছোটখাটো ব্যবসা করেছেন, স্কুলে এবং কলেজে শিক্ষকতাও। সেই সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন যাবতীয় সামাজিক অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশরা লোধা-শবরদের অপরাধপ্রবণ জাতি ঘোষণা করেছিল। স্বাধীন ভারতেও সেই ঘোষণা বহাল ছিল। মহাশ্বেতা একা লড়াই করে তা রদ করলেন। তিনি গড়েছেন আদিম জাতি ঐক্য পরিষদ এবং লড়েছেন। কখনও আইনি লড়াই, কখনও মিছিল-মিটিং। নানা জনকে নানা চিঠি লিখেছেন ভারতের মূলবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য।

আরও পড়ুন- ‘আমার বর্তিকায় লেখো’! রিকশাওয়ালা মদন সেই থেকে লেখক হয়ে গেলাম

মেদিনীপুর জেলার লোধা শবরদের মতো পুরুলিয়ার খেড়িয়া শবর গোষ্ঠীর উন্নতির জন্য ভাবনাচিন্তা করেছেন প্রচুর। বস্তুত, এই গোষ্ঠীগুলির সমন্বিত মননে মহাশ্বেতা দেবী মাতৃরূপে বিরাজ করেন। ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছেন, বলা যায়— ভারতের ভূমিদাস প্রথা নিয়ে তাঁর একটা থিসিস রয়েছে, যা সমাজবিজ্ঞানের গবেষকদের কাজে লাগবে। আমি যত দূর জানি, তিনি কমপক্ষে ২০টি সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন যার মধ্যে রিকশা শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, এমনকী, বাউল ফকির, দরবেশ সংগঠনও আছে। বামফ্রন্ট সরকার এল, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে বিনা বিচারে আটকে থাকা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্যও লড়াই করেছেন, সেই ধারাবাহিকতায় লড়াই করেছেন নর্মদা বাঁধ, গুজরাত হত্যাকাণ্ড, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়েও। মহাশ্বেতা দেবীর বাড়িতে আমাকে প্রথম নিয়ে যান ‘প্রমা’ পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক সুরজিত ঘোষ, ১৯৭৯ সালে। প্রমা পত্রিকার ‘শর্ষে ছোলা ময়দা আটা’ নামে আমার লেখা একটা গল্প পড়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে ক্রমশ দরজাটার কাছে পৌঁছলাম। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মলিন ম্যাকসি পরিহিতা মহাশ্বেতাদি। উজ্জ্বল চোখ। শিহরণ হচ্ছিল। হাজার চুরাশির মা, স্তন দায়িনী, দ্রৌপদী, জল, অরণ্যের অধিকার, চেট্টিমুণ্ডা, ভাত, বায়েন, আজিরের স্রষ্টা আমার একেবারে সামনে! তিনি আমার নাম শুনে জড়িয়ে ধরলেন, কেমন হারমোনিয়ামের মতো বেজে উঠেছিলাম আমি। আমার সেই প্রথম দেখা আজও ভুলতে পারিনি। এর পর তাঁর বাড়ি অনেকবার গিয়েছি। বাড়ি পাল্টেছেন, নতুন আবাসেও। তিনি প্রশ্রয় দিতেন। শুধু আমাকেই নয়, সত্তরের লেখকদের মধ্যে অনেককেই।

মহাশ্বেতা দেবীর বাড়িতে প্রায়ই দেখতাম বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পুরুলিয়ার লোকজন রয়েছেন। কলকাতার কাছে এসে তিনিই আশ্রয়। বিছানায় নানা বইপত্র, সঙ্গে লিফলেট। ইটভাটা মজদুর সমিতির, মৃৎশিল্পী কল্যাণ সমিতির। সাহিত্যিকের টেবিল সম্পর্কে ধারণাই পাল্টে গেল। টেবিলে গ্রিলার, কিছু কাগজপত্র, আর একটা ট্রানজিস্টার। বলেছিলেন, বিবিধভারতী শুনতে শুনতে তিনি লেখেন।

আরও পড়ুন- শ্রীমহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬-২০১৬)

আবার প্রথম দিনের কথাটা বলি। নিজে কফি করে এনেছিলেন। তাঁর বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল এক দাড়ি না কাটা খসখসে চামড়ার রুক্ষসুক্ষ মানুষ। হয়তো পুরুলিয়ার বা বাঁকুড়ার। বেরিয়ে মহাশ্বেতাদির চিরুনিটা দিয়ে অবলীলায় চুলটা আঁচড়ে নিচ্ছিলেন। অথচ, আমি কফির কাপে চুমুক দিতে সংকোচে পড়ি। আসলে, মহাশ্বেতাদিকে আপন করে নেওয়ার অধিকার নিজেকেই অর্জন করে নিতে হয়।

সত্তরের অভিঘাতে আমাদের মতো একঝাঁক তরুণ লিখতে শুরু করেছিলাম। বাতাসে তখনও বারুদ গন্ধ। ক্ষত চিহ্নগুলি তখনও মসৃণ হয়নি। সামাজিক অসাম্যগুলি বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের অনেকের সামনে তখন আদর্শ লেখা হিসাবে স্থাপিত ছিল মহাশ্বেতার লেখাগুলি।

মহাশ্বেতার লেখার মধ্যে, শিকড় খোঁজার চেষ্টার মধ্যে, নিহিত রয়েছে ইতিহাস-অন্বেষণ। প্রথম দিকের লেখা ঝাঁসীর রানীতেই যে ইতিহাস অন্বেষণ আছে তা নয়। লোকবৃত্ত এবং লোক ইতিহাসে তাঁর অসম্ভব ঝোঁক। অতীত, ইতিহাস তাঁর লেখায় এসেছে। বেশ কিছু লেখায়। যেমন চম্বা, দেওয়ানা, কবি বন্দ্যঘটি গাঞির জীবন ও মৃত্যু এ রকম নানা গল্পে। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে তো অজস্র লেখা। বর্তমানও তো পরে ইতিহাস হবে। বর্তমানের মধ্যে স্থিত থাকে ইতিহাসের উপাদান। কিছু লেখায় এমন রূপকধর্ম রয়েছে, যা সর্বকালে প্রাসঙ্গিক। যেমন স্তনদায়িনী। সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়কালের লেখা হয়েও চিরকালীন। শিল্পের জন্য শিল্প করেননি তিনি। তাঁর কাছেই শিখেছি আখ্যানের ভিতরে কীভাবে মিশিয়ে দিতে হয় গান, কিংবদন্তী, ছড়া, প্রবাদ, লোককথা, ধাঁধা ইত্যাদি নানাবিধ লৌকিক উপাদান। তিনি বলেছিলেন যে লোককথা বা মৌলিক সাহিত্য থেকে পাওয়া উপাদানগুলিকে গভীর শ্রদ্ধা করেন তিনি। কেন না তা থেকে বোঝা যায় সাধারণ মানুষ ঘটনাটিকে কী চোখে দেখেছেন।

আরও পড়ুন- মহাশ্বেতা-স্মরণে: হাইলাকান্দি আপনার স্মৃতিচারণায় গর্বিত

অবাক হয়ে যাই যখন তাঁর মুখে শুনেছিলাম দ্রৌপদী, স্তনদায়িনী, বিজন এই তিনটি গল্পই এক দিনে একেকটি লেখা। মানে এক দিন সকাল থেকে সন্ধে দ্রৌপদী সৃষ্টি হয়েছে, একই রকমভাবে স্তনদায়িনী বা বিজন। প্রচণ্ড প্যাশন, অভিঘাত এবং ভালবাসা না থাকলে এটা সম্ভব নয়। হাজার চুরাশির মা চার দিনে।

দেখেছি বৃষ্টি জলের মত কী ভাবে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছেন প্রান্তিক সমাজের শিকড়ে। শুধু আদিবাসী নয়, প্রান্তিক ও দলিত মানুষের মুখ হয়ে কথা বলেছেন তিনি। নিবিড় এবং মমতাময় চোখে তিনি দেখেছেন এই সব মানুষের তক্তাপোষের তলা, ঘরের কুলুঙ্গি কিংবা চালের বাতা। গল্প উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করার পরিসর এখানে নেই। যে কটা পড়েছি মনে হয়েছে অ্যানথ্রোপলজিকাল মিউজিয়াম দেখছি। তাঁর গল্পপাঠ শুনেছি।

তিনি একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। বর্তিকা। বর্তিকার প্রতিটি সংখ্যা, সমাজবিদ্যার গবেষকদের সংগ্রহ করে রাখার মতো। একটি সংখ্যার সূচিপত্র এ রকম: লোধা জীবনের কথা, পশ্চিম মেদিনীপুরের ভূমিদাস প্রথা, ঝাড়খণ্ডের লোকগীতিতে কৃষক, ডোম জাতির কথা, অরণ্যের প্রতিরোধ, বেঙ্গল পেপার মিলের শ্রমিক, নিজের কথা: চুণী কোটাল, এ ছাড়া কিছু গল্প-কবিতা। গল্প লিখেছেন নবারুণ ভট্টাচার্য, অভিজিৎ সেন, জয়ন্ত জোয়ারদার এবং মদন দত্ত, প্রহ্লাদ ভুক্তা, ভজহরি মালো। এই মদন দত্ত তখন একজন রিকশাচালক। আজ তিনি একজন আলোচিত লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। সেই বর্তিকা পত্রিকায় একজন স্বল্পশিক্ষিত চর্মকার যেমন নিজের লেখা লিখেছেন, একজন সব্জি বিক্রেতাও তেমনই।

আরও পড়ুন- স্মৃতির পাতায় মহাশ্বেতা

তাঁর মতো বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এ সময়ের অন্য কোনও সাহিত্যিকের হয়নি। ভারতের বহু ভাষায় তাঁর বহু লেখা অনূদিত হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য বহু ভাষায়। ২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার থিম দেশ ছিল ভারতবর্ষ। উদ্বোধন করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। আমি লেখক প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। দেখেছিলাম বইমেলা কর্তৃপক্ষ তাঁর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত বইগুলি সাজিয়ে রেখেছেন। ইংরাজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান, ইতালিয়ান তো বটেই, জাপানি এবং কোরিয়ান ভাষাতেও তাঁর বই অনূদিত হয়েছে। আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম।

সব মরণ নয় সমান। তিনি নেই, কিন্তু আছেন। মৃত্যুর পরই পুনর্জন্ম হয় একজন প্রকৃত লেখকের। তিনি বাংলা লেখার যে পরিধি বিস্তীর্ণ করেছেন, পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের দায় সেই পরিধির আরও বিস্তার ঘটানো। তবেই মহাশ্বেতাদিকে সম্মান দেখানো হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE