মানল তৃণমূল

দলের দ্বন্দ্বেই ত্রিশঙ্কু বহু পুরসভা

ভোটের ফল বেরোলেও কে আসবে ক্ষমতায়, তা জানার উৎকণ্ঠা জিইয়ে রাখল রাজ্যের বারোটি পুরসভা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার দাবি করেছেন, ‘‘ত্রিশঙ্কু পুরসভাগুলি নিয়ে কথা হয়েছে। ওগুলো (বোর্ড) আমরাই করে নেব।’’ যদিও তৃণমূলের অন্দরের খবর, বেশির ভাগ পুরসভায় ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতি হওয়ার জন্য শাসক দলের ভিতরের কোন্দলই দায়ী।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫৭
Share:

দাঁইহাটে জয়ের উল্লাস। মঙ্গলবার অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

ভোটের ফল বেরোলেও কে আসবে ক্ষমতায়, তা জানার উৎকণ্ঠা জিইয়ে রাখল রাজ্যের বারোটি পুরসভা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার দাবি করেছেন, ‘‘ত্রিশঙ্কু পুরসভাগুলি নিয়ে কথা হয়েছে। ওগুলো (বোর্ড) আমরাই করে নেব।’’ যদিও তৃণমূলের অন্দরের খবর, বেশির ভাগ পুরসভায় ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতি হওয়ার জন্য শাসক দলের ভিতরের কোন্দলই দায়ী। অন্য ভাবে বলতে গেলে, এককাট্টা হয়ে ঝাঁপালে ওই পুরসভাগুলির অনেকগুলিতেই শাসক দলের ফল আরও ভাল হতো।

Advertisement

মুর্শিদাবাদে ত্রিশঙ্কু হয়ে রয়েছে দু’টি পুরসভা— ধুলিয়ান এবং বেলডাঙা। গত বোর্ডে তাদের ১৪ জন সদস্য থাকলেও এ বার ধুলিয়ানে তৃণমূল পেয়েছে ছ’টি আসন। ২১ আসনের ওই পুরসভায় বাকি আসনগুলির মধ্যে কংগ্রেস আট, বিজেপি চার, বামেরা দুই এবং নির্দল একটিতে জিতেছে। ২০১০-এ ওই পুরসভার ১৯টি আসনের মধ্যে বামেরা ১০ এবং কংগ্রেস ন’টিতে জেতে। পরে কংগ্রেসের নয় এবং বামেদের পাঁচ জন তৃণমূলে যোগ দেন। দলে পরে আসাদের সঙ্গে এলাকার তৃণমূল নেতাদের একাংশের বিবাদই এ বারের ভোটে দলকে ডুবিয়েছে বলে দাবি তৃণমূল সূত্রের।

প্রায় একই ছবি বেলডাঙাতেও। ২০১০-এ সেখানে ১৪টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১০, বামফ্রন্ট তিন এবং বিজেপি একটি আসনে জেতে। মাস ছয়েক আগে কংগ্রেসের চার পুরপিতা তৃণমূলে যোগ দেন। এ বার সেখানে কংগ্রেস সাত, বামফ্রন্ট চার ও বিজেপি তিনটি আসনে জিতেছে। শাসক দলের খাতা ফাঁকা। তৃণমূল সূত্রের খবর, কংগ্রেস থেকে লোক নেওয়া নিয়ে দলের অন্দরে অস্বস্তি ছিল। ভোটের আগে কোন্দল আরও বাড়ে। সেই সূত্রেই এই দশা হয়েছে।

Advertisement

অস্বস্তি লুকোননি জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান হোসেন। বলেছেন, ‘‘গোটা জেলায় দলের বহু নেতার মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই। এই পরিস্থিতিতেও বেলডাঙা এবং ধুলিয়ানে ভাল ফল আশা করেছিলাম। কিন্তু তা হল কই!’’

উত্তর ২৪ পরগনার টাকিতে (১৬টি আসন) গত বার ছ’টি আসনে জিতে কংগ্রেস এবং নির্দলের সমর্থনে বোর্ড গড়েছিল তৃণমূল। এ বার সেখানে তৃণমূল জিতেছে আটটিতে, বামেরা পাঁচ এবং বিজেপি তিনটিতে জিতেছে। তৃণমূলের অন্দরের খবর, এখানেও দলকে ভুগিয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।

হুগলির ভদ্রেশ্বর পুরসভাও একক ভাবে বোর্ড দখল করতে পারেনি শাসক দল। সেখানে ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে তাদের দৌড় ১১ পর্যন্ত পৌঁছেই থমকে গিয়েছে। অন্য দিকে সিপিএম ছ’টি, বিজেপি ও কংগ্রেস দু’টি করে এবং নির্দল একটি আসন পাওয়ায় ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পুর বোর্ড। জেলা তৃণমূলের এক তাবড় নেতার কথায়, ‘‘ওখানে কিছু সমস্যা রয়েছে। দেখি, কত দূর কী করতে পারি।’’

তৃণমূল সূত্রের দাবি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভাল ফলের পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুরেও। ৩৫টি ওয়ার্ডের খড়্গপুর পুরসভায় এ বার তৃণমূল ১১, কংগ্রেস ১১, বিজেপি সাত ও বামেরা ছ’টি আসন পেয়েছে। আগের বোর্ডে তৃণমূলের ১৬ জন ছিলেন। এই রেল-শহরে ভোট পর্বের শুরু থেকেই তৃণমূলের প্রাক্তন পুরপ্রধান জহরলাল পাল ও দলের শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরীর বিবাদ মেটাতে হিমশিম খেয়েছেন দলের জেলা নেতৃত্ব। তৃণমূলের এক নেতার দাবি, ‘‘দলের অন্দরের সমস্যার জন্যই পাঁচ জন বিদায়ী কাউন্সিলর হেরেছেন।’’

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই শাসক দলের সমস্যার কারণ পুরাতন মালদহ পুরসভাতেও। গত বার ওই পুরসভার ১৮টি আসনে বামেরা ছিল ১২, কংগ্রেস ছয়। পরে কংগ্রেসের ছ’জন ও বামেদের চার জন তৃণমূলে চলে যান। কিন্তু পুরভোটের প্রার্থীপদ নিয়ে তৃণমূলে কোন্দল শুরু হয়। পরিবারের লোকজনদের প্রার্থী করার অভিযোগ ওঠে বিদায়ী পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে। তার পরেই পাঁচটি ওয়ার্ডে নির্দল হিসাবে দাঁড়িয়ে পড়েন বিক্ষুব্ধেরা। এ বার পুরসভায় আসন ২০। তার মধ্যে তৃণমূল ১০, বিজেপি পাঁচ, সিপিএম দুই ও নির্দল তিনটি আসন পেয়েছে। তৃণমূল ছেড়ে নির্দল হিসাবে যারা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের দু’জন জিতেছেন।

কোচবিহার পুরসভার ফলেও পড়েছে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছায়া। সেখানে বিদায়ী বোর্ডে তৃণমূলের সদস্য ছিলেন ১৫ জন, বামেরা পাঁচ। এ বার ২০ আসনের কোচবিহার পুরসভায় তৃণমূল একক ভাবে ১০টি, বামফ্রন্ট আটটি ও নির্দল দু’টি আসনে জয়ী হয়েছে। দুই বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবে জিতেছেন।

প্রায় একই ছবি বাঁকুড়া পুরসভাতেও। সেখানে ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল ১২টিতে জয়ী। বামেরা পাঁচ, কংগ্রেস এক, বিজেপি দুই এবং নির্দল চারটিতে জিতেছেন। ওই পুরসভাতে তৃণমূলের পাঁচ বিক্ষুব্ধ নির্দল হয়ে লড়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক জন আবার তৃণমূলের এক প্রাক্তন পুরপ্রধানকে হারিয়েওছেন।

পশ্চিম মেদিনীপুরের রামজীবনপুরে ছিল মহাজোট। কিন্তু সেখানে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে ছিল বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের ‘দুর্নীতি বিরোধী মঞ্চ’। এ বার রামজীবনপুর ১১টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পাঁচ, জোট সমর্থিত নির্দল চার এবং দু’টি আসনে জিতেছে বিজেপি। হিসেব মতো এই ফল ত্রিশঙ্কু। কিন্তু জয়ী বিজেপি প্রার্থীরা প্রকাশ্যেই বলছেন, তাঁরা মহাজোটকে সমর্থন করবেন। অর্থাৎ, গত দু’বারের ধারা বজায় রেখে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই পুরসভায় বোর্ড গড়তে চলেছে শাসক বিরোধী মহাজোট।

তবে কিছু পুরসভা ত্রিশঙ্কু হওয়ার পিছনে শাসক দলের নিজস্ব সমস্যার বাইরের কারণও রয়েছে। যেমন—দক্ষিণ ২৪ পরগনার ১৪ আসনের জয়নগর-মজিলপুর পুরসভায় গত বার মাত্র দু’টি আসনে জিতে এসইউসি ও নির্দলকে নিয়ে বোর্ড গড়েছিল তৃণমূল। এ বারও ত্রিশঙ্কু পুরবোর্ড। তৃণমূল এখানে পেয়েছে চারটি আসন। কংগ্রেস ছয়, এসইউসি দুই, সিপিএম এবং নির্দল পেয়েছে একটি করে আসন। কয়েকটি ওয়ার্ডে এখানে স্থানীয় স্তরে আসন সমঝোতা করে লড়েছে কংগ্রেস-এসইউসি-বিজেপি-বামেরা। জেলা তৃণমূলের দাবি, এটা ‘অশুভ শক্তির জোটের জয়।’

উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে বিরোধীদের ‘রামধনু জোট’ নিয়ে প্রচার-পর্বে সরব ছিল তৃণমূল। ৪৭ আসনের ওই পুরসভায় বামেরা ২৩টি, তৃণমূল ১৭টি, কংগ্রেস চারটি, বিজেপি দু’টি, নির্দল একটি আসনে জিতেছে। সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য সেখানে শাসক দলকে টক্কর দিয়েছেন। ‘ম্যাজিক ফিগার’ ২৪-এ পৌঁছতে বামেদের দরকার মাত্র একটি সমর্থন।

স্থানীয় বিধায়ক তথা পুরভোটে জয়ী প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে সামনে রেখে বর্ধমানের কাটোয়াতে তৃণমূলের সঙ্গে যুঝেছে কংগ্রেস। ভোটের দিন এই কাটোয়ায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। আর তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, কংগ্রেস-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের গুলিতে প্রাণ গিয়েছে তাদের কর্মীর। রাজ্যের একমাত্র এই পুরসভায় ফল ‘টাই’। তৃণমূল ১০, কংগ্রেস ১০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন