Maoist

রাজ্যে জমি ফেরাতে তৃণমূলের ‘বড় মাথা’দের সরানোর ছক মাওবাদীদের!

উদ্ধার হওয়া নথি অনুযায়ী, ঠিক একই ভাবে ২০১১ সালেও তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর এ রাজ্যে আলোচনার পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেই আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে অন্য রাজ্য থেকে জঙ্গলমহলে গিয়েছিলেন কিষেণজি।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৮ ১৮:২০
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

নিচুতলা থেকে শীর্ষ স্তর পর্যন্ত নেতৃত্ব বদলের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর নতুন নেতাদের হাত ধরে আসছে চাপের মুখে টিকে থাকার নতুন স্ট্র্যাটেজিও। নতুন নেতার ‘নয়া দাওয়াই’ দিয়েই ফের এ রাজ্যে নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে চাইছেন মাওবাদীরা।

Advertisement

লালগড় থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার তাঁদের টার্গেট শাসক দলের বড় মাথারা। যাঁদের আঘাত করলে এক দিকে শাসক দলে আতঙ্ক ছড়াবে, একই সঙ্গে ভেঙে দেওয়া যাবে প্রতিরোধ।

দীর্ঘ ১৫ বছর পর অন্ধ্রপ্রদেশে যে ভাবে ধীরে ধীরে মুছে যাওয়া সংগঠনকে ফের গড়ে তুলেছেন মাওবাদীরা, ঠিক একই মডেলে এ রাজ্যেও ফিরে আসার পরিকল্পনা তাদের। সম্প্রতি ছত্তীসগঢ় এবং ঝাড়খণ্ডে মাওবাদী ডেরা থেকে উদ্ধার কিছু নথির ভিত্তিতে এমনটাই ধারণা গোয়েন্দাদের। তবে, উদ্ধার হওয়া সমস্ত নথিই ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের। ফলে গোয়েন্দারা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: রাজনৈতিক সংগঠনেও এ বার মিটুর ঝড়!

২০০৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ, অন্য দিকে ২০১১ সালে জঙ্গলমহল। অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রকাশ্যে চলে এসেছিলেন শীর্ষ মাওবাদী নেতৃত্ব। আলোচনা ভেস্তে যেতেই পুলিশি অভিযান শুরু হয়ে যায়। ধরা পড়ে যান বা পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান অনেক নেতা। ধীরে ধীরে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে মুছে যায় মাওবাদী সংগঠন।

রাজ্যের গোয়েন্দারা মনে করছেন, এখন থেকেই এরকম বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। —ফাইল চিত্র

উদ্ধার হওয়া নথি অনুযায়ী, ঠিক একই ভাবে ২০১১ সালেও তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর এ রাজ্যে আলোচনার পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেই আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে অন্য রাজ্য থেকে জঙ্গলমহলে গিয়েছিলেন কিষেণজি। ওই নথিতে আনা অভিযোগ অনুযায়ী, অন্ধ্রের কায়দাতেই সরকার ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে। খুন করা হয় কিষেণজিকে। তার পর মাওবাদী সংগঠন কার্যত মুছে যায় এ রাজ্য থেকে।

তাই দীর্ঘ ১৫ বছর পরে অন্ধ্রপ্রদেশে যে ভাবে সংগঠন তৈরি করা হয়েছে, ঠিক সেই ভাবেই ফিরতে হবে পশ্চিমবঙ্গেও।

মঙ্গলবার গোয়ালতোড় থেকে ধৃত রাজ্য স্তরের মাওবাদী নেতা সব্যসাচী গোস্বামী এবং তাঁর তিন সঙ্গীর কাছ থেকে উদ্ধার নথিও সেই ধারণাকেই জোরদার করেছে।

২০১৭ সালে সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সাংগঠনিক রদবদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। শারীরিক ভাবে অক্ষম এবং মানসিক চাপ নিতে যাঁরা পারছেন না, তাঁদের সাংগঠনিক নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাওবাদী কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের প্রধান কেশব রাও ওরফে বাসবরাজকে সংগঠনের সর্বোচ্চ পদাধিকারী গণপতির স্থলাভিষিক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই ভাবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে আসা হয় কিছু নতুন মুখ। এমনই কিছু নথি হাতে পেয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশ স্পেশ্যাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তাঁদের সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, প্রায় এক বছর ধরে এই নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলেছে এবং তা শেষ পর্যায়ে।

লালগড় আন্দোলনের সময় এভাবেই প্রশাসনকে জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল রাস্তা কেটে। —ফাইল চিত্র

গোয়েন্দাদের হাতে আসা মাওবাদী সংগঠনের বিভিন্ন নথি অনুযায়ী, দলের নতুন প্রধান এ রাজ্যে শাসক দলের বড় এবং মাঝারি মাপের নেতৃত্বের উপর আঘাত করার পরিকল্পনা করছে। লালগড় আন্দোলনের সময় যে নির্বিচারে ব্যক্তি হত্যা হয়েছিল, সেই হত্যা জঙ্গলমহলে সংগঠনের জনপ্রিয়তা হারানোর অন্যতম কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাই এ বার ব্যক্তিহত্যা নিয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে রাজ্য নেতৃত্বকে।

আরও পড়ুন: বড়মার জন্মদিন উদ্‌যাপনে গিয়ে মতুয়া ঐক্যের ডাক মমতার, এনআরসি নিয়ে ফের আক্রমণ

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, সাধারণ মানুষের উপর আঘাত না করে, নেতৃত্বের উপর আঘাত করতে বলা হয়েছে। ঠিক যে ভাবে অন্ধ্রপ্রদেশের আরাকু উপত্যকায় তেলুগু দেশম বিধায়ক এবং প্রাক্তন বিধায়ককে হত্যা করেছে মাওবাদীরা সেপ্টেম্বর মাসে। অন্ধ্রপ্রদেশের মাওবাদী দমনে যুক্ত (এপিএসআইবি)-র গোয়েন্দারা নিশ্চিত, এই হত্যার পরিকল্পনা খোদ বাসবরাজের।

বুধবার মেদিনীপুরের গুরগুড়িপালে উদ্ধার হওয়া মাওবাদী পোস্টার। —নিজস্ব চিত্র

গোয়েন্দাদের দাবি, পরিকল্পনা খুব পরিষ্কার। নেতৃত্বের উপর আঘাত হানলে তাঁদের জঙ্গলমহলের অন্দরে আনাগোনা অনেক কমে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যে অসন্তোষ জমা হচ্ছে জঙ্গলমহলের মানুষের মনে, সেই অসন্তোষ আরও বাড়বে শাসক নেতাদের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব বাড়লে। সেই ফাঁকটাই কাজে লাগাতে হবে সংগঠকদের। তবে বার বার অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে আরও ধৈর্য্য এবং সংযমের কথা বলা হয়েছে রাজ্য নেতৃত্বকে। সংগঠনের মধ্যেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে নয়া নথিতে। বলা হয়েছে, এই সরকারের আমলে নিযুক্ত যে সিভিক পুলিশরা জঙ্গলমহলে রাষ্ট্রের (পুলিশের) চোখ-কান, সেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে প্রয়োজনে। যাতে তাঁদেরকেই সংগঠনের প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায়।

এ সব কিছুর পর, জঙ্গলমহলে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর কোনওটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে মানতে নারাজ গোয়েন্দাদের একটা বড় অংশ। এক গোয়েন্দাকর্তা বলেন, “কিছু দিন আগে মাও গেরিলা স্কোয়াডের নেতা মদন মাহাতো যোগাযোগ করেছিলেন এক সিভিক ভলান্টিয়ারের সঙ্গে। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম আত্মসমর্পণ করতে চান তিনি। তবে এখন ওদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হচ্ছে।”

যদিও কলকাতা পুলিশের এসটিএফ সহ, মাওবাদী দমনে যুক্ত সিআইএফের মতো বাহিনীর শীর্ষকর্তাদের দাবি, এই মুহূর্তে এ রাজ্যে হাতে গোনা মাও নেতৃত্ব এবং গেরিলা রয়েছেন যাঁরা মূলত পড়শি ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাঁদের পক্ষে সংগঠন ফের আগের মতো গড়ে তোলা বা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা অসম্ভব। যদিও গোয়েন্দাদের একটি অংশ মনে করছেন, স্থানীয় পর্যায়ে সমর্থন পেলে সেই দুর্বলতা কাটাতে সময় লাগবে না মাওবাদীদের। তাই এখন থেকেই বাড়তি সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন।

বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া - পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন