রঞ্জিতের আত্মসমর্পণে খুশি মা

‘সেই সোজা পথেই ফিরতে হল’

এক শ্রাবণ মাসে চাষের কাজে পুবে খাটতে গিয়েছিলেন বাবা, মা। বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন দুই ছেলে ও এক মেয়েকে। ফিরে এসে মেয়ের কাছে শুনলেন, ‘দাদা এক দিন দুপুরে লুঙ্গি পরে বাস ধরে কোথায় যেন চলে গেল। আর ফেরেনি’।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বারিকুল শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:৩৭
Share:

খেজুরখন্নার বাড়িতে রঞ্জিত পালের ভ্রাতৃবধূ, মা এবং ভাই। বুধবার উমাকান্ত ধরের তোলা ছবি।

এক শ্রাবণ মাসে চাষের কাজে পুবে খাটতে গিয়েছিলেন বাবা, মা। বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন দুই ছেলে ও এক মেয়েকে। ফিরে এসে মেয়ের কাছে শুনলেন, ‘দাদা এক দিন দুপুরে লুঙ্গি পরে বাস ধরে কোথায় যেন চলে গেল। আর ফেরেনি’।

Advertisement

ফেরার কথাও ছিল না রঞ্জিত পালের। কারণ, ফেরার জন্য তো আড়াই দশক আগে বাড়ি ছাড়েননি সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা ওই স্কুলছাত্র। ছেড়েছিলেন সিপিআই (মাওবাদী)-র স্কোয়াডে কাজ করবেন বলে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’-এ নামবেন বলে। রঞ্জিত অবশ্য তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম। নিতিন, রাহুল, প্রভাতজী, সিরাজ—এমন আরও অনেক নাম আছে তাঁর। মাওবাদীদের বিভিন্ন স্কোয়াডে থাকাকালীন বারিকুলের খেজুরখন্না গ্রামের রঞ্জিতকে এমন নানা নামে ডাকাতেন বাকি সদস্যেরা।

১৯৯৮ সালে সেই যে বাড়ি ছেড়েছিলেন, তার পর থেকে এ রাজ্যের জঙ্গলমহলে একের পর এক মাওবাদী নাশকতার ঘটনায় নাম জড়িয়েছে রঞ্জিতের। তাঁর খোঁজ পেতে রাতবিরেতে গ্রামের বাড়িতে হানা দিয়েছে পুলিশ। পরিবারের সদস্যদের পড়তে হয়েছে জেরার মুখে। কিন্তু, রঞ্জিত ছিলেন অধরা। বুধবার হঠাৎই টিভি-র পর্দায় খবরের চ্যানেলে সেই রঞ্জিতের সস্ত্রীক আত্মসমর্পণের খবর দেখে খেজুরখন্নায় আলোড়ন পড়ে গিয়েছে।

Advertisement

রানিবাঁধ থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে, রানিবাঁধ-বারিকুল রাস্তায় ছোট্ট গ্রাম খেজুরখেন্না। এ দিন গ্রামে ঢুকে মাটির দোতলা বাড়িটার সামনে পৌঁছতেই চোখে পড়ল ছোটখাটো জটলা। এ বাড়িতে আগেও আসা হয়েছে কয়েক বার। কিন্তু, প্রত্যেক বারই চোখে পড়েছে, এক অদ্ভুত নীরবতা। এ দিনের ছবিটা বিলকুল আলাদা। বাড়ির ‘দিশা-হারা’ ছেলে ফের মূলস্রোতে ফিরেছে, খবরটা চাউর হতে বেশি দেরি হয়নি।

হারিয়ে যাওয়া সেই বড় ছেলে জঙ্গল-জীবন ছেড়ে ‘আত্মসমর্পণ’ করুন, এটাই এত বছর ধরে মনে মনে চাইতেন অলকা পাল। চেয়েছিলেন, ছেলে ফিরুক ‘জীবিত’ অবস্থায়। হলও তাই। এ দিন বাড়ির দাওয়ায় বসে রঞ্জিতের ঘর ছাড়ার ঘটনা শোনাচ্ছিলেন ওই প্রৌঢ়া। রঞ্জিত তখন বারিকুল হাইস্কুলের ছাত্র। সবে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। এরই মধ্যে কয়েক বার মাওবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতেও ধরা পড়েছেন। রঞ্জিতের মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ ভাল চোখে নেয়নি পরিবার। এ নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে রঞ্জিতের অশান্তি বেঁধেই থাকত। এরই মাঝে হঠাৎ এক দিন বাড়ি ছাড়েন রঞ্জিত। একরাশ আক্ষেপ ছুড়ে অলকাদেবী বললেন, “তখন গলায় কাপড় দিয়ে পায়ে ধরে বলেছিলাম, ওই পথে যাস না বাবা। মায়ের কথা সেদিন শোনেনি। আজ তো সেই সোজা পথেই ফিরতে হল! মাঝে এতগুলো বছর বুকে যন্ত্রণা চেপে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করে কাটাতে হল আমাদের।’’

অ্যাসবেসটসের ছাউনির মাটির ঘরে বসে টিভিতে একের পর এক খবরের চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলেন অলকাদেবী। রঞ্জিত বিয়ে করেছেন, সেই খবর জানলেও বৌমাকে স্বচক্ষে দেখননি। এ দিন ছেলে-বৌমা যখন পাশাপাশি আত্মসমর্পণ করছেন, টিভিতে অনেকেই সেই দৃশ্য দেখলেও ওই সময় ছাগল চরাতে গিয়েছিলেন অলকাদেবী। এ নিয়ে আফসোস যাচ্ছে না। তাঁর কথায়, “বৌমাকে নিজের চোখে দেখিনি। টিভিতে সবাই দেখতে পেল। আমি পেলাম না।’’

রঞ্জিতের আত্মসমর্পণের খবর পেয়েই অলকাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন পড়শি বধূ ববিতা পাল। বললেন, “বিয়ে করে এই গ্রামে আসার পর থেকেই রঞ্জিতের নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। আমার স্বামীর কাছে শুনেছি, ও খুব বুদ্ধিমান ছাত্র ছিল। ও আত্মসমর্পন করায় আমরা খুশি।’’ গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা শ্যামাপদ পাল, মঙ্গল পালদের কথায়, “খুব ছোট অবস্থায় দেখেছি রঞ্জিতকে। এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। কী জানি আমাদের মনে থাকবে কিনা।’’

এ দিন রঞ্জিতের বাবা সত্য পাল গিয়েছিলেন বেলপাহাড়ির কেচন্দায়, ছোট ছেলে হরিপদর শ্বশুরবাড়িতে। হরিপদবাবু ফোনেই বাবাকে সুখবর দেন। রঞ্জিত যখন বাড়ি ছাড়েন, তখন বছর আটেকে বয়স হরিপদর। তাই দাদার কথা খুব বেশি এখন আর মনে নেই তাঁর। তবে ওই ছোট বয়স থেকেই দাদার জন্য পুলিশের কাছে কম নির্যাতিত হতে হয়নি হরিপদকে। সেই সবই মনে রয়েছে। এ দিন টিভিতে দাদা-বৌদিকে দেখেছেন। তিনি বলেন, “দাদার স্নেহ বা ভালবাসা কী জিনিস, তা আজও জানলাম না। কিন্তু, দাদার জন্য পুলিশের চড়-থাপ্পড় সবই সহ্য করতে হয়েছে। তবে দাদা সঠিক পথে ফিরে আসবে, জানতাম। এই দিনটার অপেক্ষাতেই এত দিন ছিলাম।’’

সস্ত্রীক রঞ্জিত বাড়ি ফিরবেন কখন, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরছে খেজুরখেন্নার ঘরে ঘরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন