লেখাপড়া করে তবেই বিয়ে, পণ খাদেজাদের

কেউ ফোন করে বসছে চাইল্ড লাইন কিংবা থানায়। কেউ হাঁফাতে হাঁফাতে স্কুলে গিয়ে বলছে, ‘‘বাঁচান স্যার, আমি বিয়ে করব না।’’ শনিবার দুপুরে ক্লাস সেভেনের খাদেজা মণ্ডলের এমন আকুতি শুনেই চমকে উঠেছিলেন নদিয়ার ধানতলার সলুয়া অ্যাকাডেমির শিক্ষিক-শিক্ষিকারা।

Advertisement

সৌমিত্র সিকদার

রানাঘাট শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:১১
Share:

খাদেজা মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র।

বৃত্তটা ক্রমে বড় হচ্ছে।

Advertisement

পুরুলিয়ার রেখা ও বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুনদের দেখানো পথে রুখে দাঁড়াচ্ছে ওরা। ধনুকভাঙা পণ— ‘আগে লেখাপড়া। তার পরে বিয়ে।’

কেউ ফোন করে বসছে চাইল্ড লাইন কিংবা থানায়। কেউ হাঁফাতে হাঁফাতে স্কুলে গিয়ে বলছে, ‘‘বাঁচান স্যার, আমি বিয়ে করব না।’’

Advertisement

শনিবার দুপুরে ক্লাস সেভেনের খাদেজা মণ্ডলের এমন আকুতি শুনেই চমকে উঠেছিলেন নদিয়ার ধানতলার সলুয়া অ্যাকাডেমির শিক্ষিক-শিক্ষিকারা। সকাল থেকে কিছু খায়নি শুনে চোখের জল মুছিয়ে মিড-ডে মিলের খিচুড়ি খাইয়ে দেন শিক্ষিকা কৃষ্ণা চৌধুরী। তার পরে পুলিশ আর স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা যান খাদেজার বাড়ি, রানাঘাটের রঘুনাথপুরে। খাদেজার পরিবার ভুল কবুল করে মুচলেকা দিয়েছেন, মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে সাবালিকা হবে। তার পরেই বিয়ের কথা ভাববেন। খাদেজা বলছে, ‘‘এ ছাড়া আমার আর অন্য পথ খোলা ছিল না। লেখাপড়া শিখে যে দিন নিজের পায়ে দাঁড়াব, বাবা-মা-ই সব থেকে খুশি হবে!’’

প্রায় প্রতি সপ্তাহেই জেলায় জেলায় ঘটছে এমন ঘটনা। পরিবারের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে প্রশাসন বা স্কুলের দ্বারস্থ হওয়ার মতো সাহস সঞ্চয় করে নিচ্ছে মেয়েরা। সরকার এবং গণমাধ্যমের প্রচারের সুফল তো বটেই, সমাজবিদরা মনে করছেন, লেখাপড়া শিখে স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্নটা এত দিনে সমাজের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত ছড়াচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও মেয়েরা যে ভাবে এগিয়ে আসছে, তা প্রায় এক সমাজবিপ্লবের সমতুল।

হপ্তাখানেক আগে ধানতলার পাঁচবেড়িয়া হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির পিঙ্কি দাসও শিক্ষকদের কাছে ছুটে গিয়ে বিয়ে রুখেছে। মানবাজারের সায়রা খাতুন থানায় গিয়ে বলে এসেছে, ‘‘বিয়ে নয়, এখন ফুটবল খেলব।’’ পুরুলিয়া থেকে পাত্রসায়র, নদিয়া থেকে নওদা— ভয়ডর ভুলে গর্জে উঠছে ওরাই!

মুর্শিদাবাদের সিঙ্গার হাই স্কুলের ছাত্রী জুলেখা খাতুন নিজের বিয়ে রুখে দিয়েছিল। তার পরে আর বাড়িতে ঠাঁই হয়নি তার। স্কুলের ল্যাবরেটরিতে থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছে। এখন সরকারি হোমে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। চোখের জল মুছে এ মেয়েরও এক গোঁ, ‘‘নিজেকে প্রমাণ করতে আরও কষ্ট সইতে রাজি।’’

আরও পড়ুন: দুর্ঘটনায় দুই ভাই, মন্ত্রী রক্ষাকর্তা

হরিহরপাড়ার জাকিরুন বিবিকে এক ডাকে চেনে তামাম মুর্শিদাবাদ। নাবালিকার বিয়ে হলে প্রথম ফোনটাই আসে তাঁর কাছে, ‘‘জাকিরুন আপা, শিগ্‌গির এসো গো!’’ নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছোটেন বছর পঁয়ত্রিশের জাকিরুন। ছ’মাসে অন্তত পঞ্চাশটি নাবালিকার বিয়ে রুখেছেন তিনি। এখন হরিহরপাড়া ও লাগোয়া এলাকায় কেউ পাঁজি কিনলে কন্যাশ্রী যোদ্ধাদের মারফত জাকিরুনের কাছে খবর চলে আসে। ইংরেজবাজারের বিউটি খাতুন বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে দেখেছিল, পাত্রী নাবালিকা। সেখানেই গর্জে ওঠে সে। বেদম মার খায় দশম শ্রেণির বিউটি। কিন্তু সে বিয়ে বন্ধ হয়।

পুরুলিয়ার সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট লেবার কমিশনার প্রসেনজিৎ কুণ্ডু যিনি গল্পের ছলে রেখা, কালিন্দী, আফসানাদের বোঝাতেন নাবালিকা বিয়ের অভিশাপের কথা, তিনি এখন কালিম্পঙের ডেপুটি লেবার কমিশনার। তিনি বলছেন, ‘‘এই স্বপ্নটাই তো দেখেছিলাম। কন্যাশ্রী-সহ রাজ্য সরকারের একাধিক প্রকল্প, ও গণমাধ্যমগুলির লাগাতার প্রচার সেই স্বপ্নকে সত্যি করছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন