৬৮ বছর পরে ইন্ডিয়ার নাগরিক হয়ে ফিরছেন ছাবুর আলি

ঝাঁকড়া পাকুড় গাছটায় ঠেস দিয়ে বসে পড়েন ছাবুর আলি। বীজতলা রোয়া সবুজ মাঠ ফুঁড়ে কাঁটাতারের বেড়া, দৃষ্টি আরও ছড়িয়ে দিলে সীমান্তের ওপারে পাগলাহাটের আটপৌরে গৃহস্থালি। তাঁর অশীতিপর চোখে আবছা ধরা পড়ছে এ সবই। পাকুড়ের ছায়ায় বসে সীমান্তের সেই অনন্ত পরিসরে দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার মাঝে আচমকা ঝাঁঝিয়ে উঠছেন ছাবুর— ‘‘বাপ-জানের ভিটের তনে (সঙ্গে) জড়িয়ে রয়েছি এত গুলান বছর, তবু ইন্ডিয়া আমার দ্যাশ নয়?’’ আঠষট্টি বছর পরে, শুক্রবার সেই ‘ইন্ডিয়া’ তাঁকে ফিরিয়ে নিল দেশে।

Advertisement

রাহুল রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৫ ০৪:১৪
Share:

মশালডাঙা ছিটমহলের বাসিন্দা ছাবুর আলি।

ঝাঁকড়া পাকুড় গাছটায় ঠেস দিয়ে বসে পড়েন ছাবুর আলি। বীজতলা রোয়া সবুজ মাঠ ফুঁড়ে কাঁটাতারের বেড়া, দৃষ্টি আরও ছড়িয়ে দিলে সীমান্তের ওপারে পাগলাহাটের আটপৌরে গৃহস্থালি।

Advertisement

তাঁর অশীতিপর চোখে আবছা ধরা পড়ছে এ সবই। পাকুড়ের ছায়ায় বসে সীমান্তের সেই অনন্ত পরিসরে দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার মাঝে আচমকা ঝাঁঝিয়ে উঠছেন ছাবুর— ‘‘বাপ-জানের ভিটের তনে (সঙ্গে) জড়িয়ে রয়েছি এত গুলান বছর, তবু ইন্ডিয়া আমার দ্যাশ নয়?’’ আঠষট্টি বছর পরে, শুক্রবার সেই ‘ইন্ডিয়া’ তাঁকে ফিরিয়ে নিল দেশে।

তখন তাঁর নিতান্ত কিশোরবেলা, এক নিঝুম দুপুরে মশালডাঙা গ্রামে পুলিশ এসে ঘোষণা করে গিয়েছিল তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব হারানোর কথা। জীবনের নানা পর্বে ‘বাপ-জানের’ ভিটে আঁকড়ে সেই হারানো নাগরিক পরিচয়ই খুঁজেছেন ছাবুর।

Advertisement

১৯৪৭’র ১৫ অগস্টের সকালটা এখনও ঠারেঠোরে মনে করতে পারেন ছাবুর আলি। দেশ ভাগের পরে নব্য ভারতের তে-রঙা পতাকা নিয়ে দিনভর গ্রামে ছুটে বেরিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আব্বাজানের ভিটের উপরে কখন যে নিশ্চুপে ছিটমহলের তকমা পড়ে গিয়েছে জানতেই পারেননি সে দিনের সদ্য-কিশোর। দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দে অবশ্য দিন কয়েকের মধ্যে ঢেকে দিয়েছিল দেশ ভাগের ছায়া। ছাবুর বলছেন, ‘‘আমাগো মশালডাঙার নতুন নাম হইল ছিটমহল। আর আমরা রাতারাতি হইলাম এক না-দেশের বাসিন্দা।’’

ছাবুরের ভাই হামিদ আলিও মশালডাঙার বাসিন্দা। তিনি জানাচ্ছেন, ছিটের পরিচয়হীন জীবনযাপনে অন্যদেরও দুর্ভোগ কম হয়নি। কিন্তু বিবিধ অসুবিধার সঙ্গে এক সময়ে সমঝোতা করে নিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁর দাদা মন থেকে তা মেনে নিতে পারেননি। সরকারি কর্তারা মাঝে মধ্যে গ্রামে এলে তাঁর দাদা তাই যেচে নিজের পরিচয় দিতেন— ‘ছাবুর আলি, সাকিন: মশালডাঙা, ইন্ডিয়া।’ হামিদ বলছেন, ‘‘সে ঠিকানা সরকারি খাতায় গ্রাহ্য হত না ঠিকই কিন্তু ‘আমি ইন্ডিয়ায় থাকি’ এইটুকু বলার মধ্যেই যেন স্বস্তি পেতেন দাদা।’’

১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের আনাচ কানাচে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। পরের বছরেই তা ছড়িয়ে পড়েছিল শ্রীহট্ট থেকে বগুড়া, তামাম পূর্ব পাকিস্তানে। শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাশে দাঁড়িয়েছিল মুক্তি যোদ্ধাদের। ছাবুরের স্মৃতি বলছে— মশালডাঙা ছিট ফুঁড়েই ভারতীয় সেনা সীমান্ত পেরিয়ে হানা দিয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। এক রাতে সেনাবাহিনীর পিছু নিয়ে গ্রাম ছেড়ে গিয়েছিলেন ছাবুর। তার পরে জড়িয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহ-সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘ছাবুর ভাই ভারত বলতে অজ্ঞান। ভারতীয় ফৌজকে সাহায্য করতেই তাঁদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি।’’ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সেই গনগনে দিনগুলোও মনে আছে ছাবুর আলির। হলদিবাড়ির সীমান্তে গুলির লড়াই, খান সেনাদের বাঙ্কার আক্রমণ— হাঁটুর উপরে যুদ্ধের ক্ষত চিহ্ন দেখিয়ে ছাবুর বলছেন, ‘‘ইন্ডিয়ান ফৌজরে সাহায্য করব না তা হয়!’’

তবে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠার পরেও ছাবুর ফিরে এসেছিলেন তাঁর পুরনো ঠিকানা, মশালডাঙার সেই ছিটমহলে। স্ত্রী ফতিমা বিবি বলছেন, ‘‘ইন্ডিয়ার মাটিতে না ফিরলে আমার কর্তার প্রাণ জুড়ায় না।’’

সেই কোন ছেলেবেলায় গ্রামের শেষ মাথায় একটা পাকুড় গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। জীবনের প্রান্তে এসে সেই পাকুড়ের ছায়ায় নতুন করে যেন দেশ খুঁজে পেলেন ছাবুর আলি।

ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন