শান্তনু ঠাকুর, সুব্রত ঠাকুর, মমতাবালা ঠাকুর— মতুয়া মহাসঙ্ঘে এখন তিন শিবির। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
হরিমন্দিরের পিছন দিকে কাঠাখানেক ফাঁকা উঠোন। তার ও পারে পাঁচিলঘেরা বাড়ির নাম ‘ঠাকুরমহল’। সে বাড়িতে থাকেন তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর। আর উঠোন পেরিয়ে ভিতর দিকে ঢুকলে ডানদিকে আর এক বাড়ি, যার নাম ‘দ্য এক্সপালশন’ (বিতাড়ন)। সেখানে বড় হয়েছেন সুব্রত ঠাকুর ও শান্তনু ঠাকুর, যাঁরা এখন বিজেপির বিধায়ক ও সাংসদ। উদ্বাস্তু হওয়ার যন্ত্রণা জিইয়ে রাখা বাড়ির নামকরণে। কয়েক বছর হল সে ছাদের নীচে শান্তনু আর থাকেন না। এ বার সুব্রতও আনুষ্ঠানিক ভাবে বেরিয়ে গেলেন শান্তনুর ছত্রছায়া ছেড়ে। মতুয়া মহাসঙ্ঘের তৃতীয় সমান্তরাল কমিটি তৈরি করলেন গাইঘাটার বিধায়ক।
‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘে’র নামে এত দিন দু’টি আলাদা কমিটি চলত। একটি বিজেপির শান্তনুকে সঙ্ঘাধিপতি হিসাবে মানে, অন্যটি তৃণমূলের মমতাবালাকে। দাদা সুব্রত এত দিন ছিলেন ভাই শান্তনুর অনুগামী গোষ্ঠীর মহাসঙ্ঘাধিপতি। নামসর্বস্ব পদ। নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরিই ছিল বনগাঁর সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনুর হাতে। সেই বন্দোবস্তে আর থাকলেন না গাইঘাটার বিধায়ক সুব্রত। রাস পূর্ণিমার আগের দিন ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়িতে নিজের অনুগামীদের সমাবেশ ডেকে আলাদা কমিটি ঘোষণা করে দিলেন সুব্রত। নতুন গোষ্ঠীর সঙ্ঘাধিপতি হলেন সুব্রত নিজেই। তবে শান্তনুর মতো তিনিও বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকেই ‘প্রধান সেবায়েত’ পদে রাখলেন। তার চেয়েও বড় চমক দিলেন ‘প্রধান উপদেষ্টামণ্ডলী’ ঘোষণা করে। প্রথম নামটি হল: শুভেন্দু অধিকারী, বিরোধী দলনেতা, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা।
শান্তনুর ছত্রছায়ায় থাকা সংগঠনের বাইরে গিয়ে সুব্রত যে সমান্তরলার কমিটি ঘোষণার তোড়জোড় করছেন, সে গুঞ্জন ঠাকুরনগরে গত কয়েক মাস ধরেই বাড়ছিল। গত শনিবার সে গুঞ্জনের সত্যতায় অনুমোদন দিয়ে সুব্রত জানিয়ে দেন, ৪ নভেম্বর তিনি আলাদা কমিটি ঘোষণা করবেন। কিন্তু গত ছ’-সাত বছরে মতুয়া মহাসঙ্ঘে এবং মতুয়া সমাজে শান্তনুর কর্তৃত্ব যে ভাবে বেড়েছে, তাকে অস্বীকার করে কারা সুব্রতর পাশে দাঁড়ান, সে দিকে অনেকেরই নজর ছিল। কমিটি ঘোষিত হতেই দেখা গেল, ধর্মীয় সংগঠনে শান্তনুর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে রাজনৈতিক সংগঠনে নিজের মাথার উপরে থাকা ছত্রছায়াকে ব্যবহারের পথ নিয়েছেন সুব্রত। বিধানসভায় যাঁর নেতৃত্বে কাজ করেন সুব্রত, সেই শুভেন্দুর ‘বরাভয়’ যে বড় ভূমিকা নিয়েছে মতুয়া মহাসঙ্ঘের তৃতীয় সমান্তরাল কমিটি গঠিত হওয়ার নেপথ্যে, তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট। শুধু শুভেন্দুকে নিজের কমিটির প্রধান উপদেষ্টা করেই ক্ষান্ত হননি সুব্রত। উপদেষ্টামণ্ডলীতে ঢুকিয়েছেন আরও ছয় বিধায়কের নাম— অসীম সরকার, স্বপন মজুমদার, অশোক কীর্তনিয়া, অম্বিকা রায়, বঙ্কিম ঘোষ, অসীম বিশ্বাস এবং পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায়। অসীম সরকার সুব্রত-গোষ্ঠীর প্রধান মুখপাত্রও হয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের ১০০টি বিধানসভা কেন্দ্রে মতুয়া ভোটের কমবেশি উপস্থিতি রয়েছে। তবে তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৬৮। সেগুলির মধ্যে ২১টি আসন এমন, যেখানে মতুয়ারাই ভোটের ফলাফলের প্রধান নির্ণায়ক। এই আসনগুলি মূলত উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁ, ব্যারাকপুর এবং নদিয়ার রানাঘাট, কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও মতুয়া ভোটের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। রাজ্য জুড়ে মতুয়াদের এই জনবিন্যাস নতুন নয়। কিন্তু মতুয়াদের সিংহভাগের সমর্থন কোনও একটি রাজনৈতিক দলের দিকে একসঙ্গে ঝুঁকছে, এই প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নতুন। শান্তনু-সুব্রতদের পিতামহ প্রমথরঞ্জন ঠাকুরও সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন। তিনি বিধানচন্দ্র রায়ের সরকারে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়ে ‘মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক’ নামক শব্দবন্ধ রাজ্য রাজনীতির খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠেনি। পরবর্তী কালে মতুয়া এলাকার গ্রামীণ অংশে বামেদের এবং শহরাঞ্চলে কংগ্রেসের প্রভাব লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মতুয়া এলাকায় তৃণমূলের প্রভাব অন্য সব দলকে ছাপিয়ে যায়। পরবর্তী কয়েক বছরে সে প্রভাব ক্রমশ বাড়তে থাকে। মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আনাগোনাও বাড়তে থাকে।
‘ভোটব্যাঙ্ক’ হয়ে ওঠা মতুয়া সমাজ তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিজেপিতে ঝুঁকে পড়া শুরু করে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে। ২০২১ সালের বিধানসভা এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও সেই প্রবণতাই বহাল থেকেছে। কিন্তু তৃণমূল তাতে হাল ছাড়েনি। মমতাবালাকে কাজে লাগিয়ে পুরনো ভোটব্যাঙ্ক ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবারও কলকাতায় এসআইআর নিয়ে মিছিলের শেষে বক্তৃতায় মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দু’জনেই মতুয়াদের বার্তা দিয়েছেন। মমতা বলেন, ‘‘মতুয়াদের ভুল বুঝিয়ে দু’নম্বরি করে টাকা তোলা হচ্ছে। বলেছিল নাগরিকত্ব দেবে। কিন্তু দেয়নি। এখন এসব করছে।’’ অভিষেকের আহ্বান, ‘‘মতুয়া ভাইবোনেদের কাছে অনুরোধ করব, বিজেপির ফাঁদে পা দেবেন না। তা হলে আপনাদের অবস্থাও অসমের ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালির মতো হবে।’’
অন্যদিকে বিজেপি শান্তনু-সুব্রতকে সামনে রেখেই মতুয়া সমাজকে আরও আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে চলেছে। মতুয়া ভোট ঘিরে রাজ্যের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের এই টানাপড়েনে রাজ্য রাজনীতিতে মতুয়াদের প্রভাব তথা মূল্য বেড়েছে। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে ফাটল ক্রমশ চওড়া হয়েছে। বিজেপির দিকে থাকা মঞ্জুলকৃষ্ণ এবং তাঁর দুই পুত্র সুব্রত-শান্তনু বনাম তৃণমূলের দিকে থাকা মমতাবালা এবং তাঁর কন্যা মধুপর্ণা— এই দুই শিবিরে আগেই ভাগ হয়ে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি। এ বার বিজেপিতে থাকা দুই সহোদরও দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেলেন।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেও সুব্রত এবং শান্তনুর বিরোধ মাথাচাড়া দিয়েছিল। সুব্রত তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন বলে জোর জল্পনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুভেন্দুর সক্রিয়তায় তা আর ঘটেনি। কিন্তু মাসখানেক আগে ঠাকুরবাড়ি চত্বরে শান্তনুর উদ্যোগে চালু হওয়া সিএএ সহায়তা শিবির ঘিরেও দুই ভাইয়ের বিরোধ ফের প্রকাশ্যে আসে। দু’জনেই পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলেন। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে জেঠিমা মমতাবালা তখন দেবরের পুত্র সুব্রতর পক্ষ নিয়েছিলেন। সুব্রত তৃণমূলে ভিড়বেন বলে আবার গুঞ্জন উঠেছিল। কিন্তু সুব্রত বিজেপিতে থেকে গিয়েই শান্তনুর নিয়ন্ত্রণে থাকা মতুয়া মহাসঙ্ঘ থেকে আলাদা হলেন, এবং সমান্তরাল কমিটিও গড়ে ফেললেন। মতুয়াভূমিতে আপাতত তিন ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন। এই ‘ত্র্যহস্পর্শ’ কোনও প্রভাব ফেলবে আগামী বিধানসভা ভোটে?