‘পেটে হাত দিয়ে অ্যাপেন্ডিক্স দেখাতে বললে তোতলাবে’

কেন এমন হাল? শিক্ষক-চিকিৎসকদের অভিযোগ, শেখায় কারও মন নেই। অধিকাংশেরই লক্ষ্য, যেনতেন এমবিবিএস পাশ করে এমডি-র প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া। কিন্তু ক্লাস না করলে পরীক্ষায় পাশ করবেন কী ভাবে? আর স্নাতক স্তরেই যদি ভিত এমন নড়বড়ে হয়, স্নাতকোত্তরে কী হবে? যে কলেজেই মেডিক্যাল পড়ুয়াদের এই প্রশ্নটা করা হোক না কেন, সমস্বরে একই উত্তর এসেছে, ‘‘ওগুলো ম্যানেজ হয়ে যাবে।’’

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:৩০
Share:

প্রতীকী ছবি।

কার্যত ফাঁকা ক্লাসঘর। যে দু’চার জন পড়ুয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন, তাঁদের কেউ মোবাইলে মুখ গুঁজে। কেউ বা গুলতানিতে। শিক্ষক নেই।

Advertisement

সম্প্রতি সপ্তাহের প্রথম দিনে সকলে গেলেন কোথায়? হস্টেলে পৌঁছে দেখা গেল, বিছানায় উপুড় হয়ে বই পড়ছেন কেউ। কোনও ঘরে তালা। ফোন নম্বর জোগাড় করে কয়েক জনকে ফোন করে জানা গেল তাঁরা খুব ব্যস্ত। কোথায়? প্রাইভেট টিউশনে। শিক্ষক কোথায়? জানা গেল, তিনি কলকাতায়। বৃহস্পতিবারের আগে দেখা মিলবে না।

এ ছবি মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের। তবে এটা অন্য যে কোনও মেডিক্যাল কলেজের ছবিও হতে পারত। কারণ, পরিস্থিতি সর্বত্রই উনিশ-বিশ। রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ে তিতিবিরক্ত প্রবীণ চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন, মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে ‘পাশ করা ডাক্তার’রা আদতে কী শিখছেন? কতটা শিখছেন? ভবিষ্যতে তাঁদের কাছে চিকিৎসার জন্য যাওয়া কতটা নিরাপদ? কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এক প্রফেসরের কথায়, ‘‘বই মুখস্থ করায় এরা তুখোড়। শরীরের কোথায়, কী রয়েছে জানতে চান। গড়গড় করে বলে দেবে। কিন্তু পেটে হাত দিয়ে অ্যাপেন্ডিক্স দেখাতে বললে তোতলাবে। বই চেনে। শরীর চেনে না।’’

Advertisement

কেন এমন হাল? শিক্ষক-চিকিৎসকদের অভিযোগ, শেখায় কারও মন নেই। অধিকাংশেরই লক্ষ্য, যেনতেন এমবিবিএস পাশ করে এমডি-র প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া। কিন্তু ক্লাস না করলে পরীক্ষায় পাশ করবেন কী ভাবে? আর স্নাতক স্তরেই যদি ভিত এমন নড়বড়ে হয়, স্নাতকোত্তরে কী হবে? যে কলেজেই মেডিক্যাল পড়ুয়াদের এই প্রশ্নটা করা হোক না কেন, সমস্বরে একই উত্তর এসেছে, ‘‘ওগুলো ম্যানেজ হয়ে যাবে।’’

ক্লাস না করে এমবিবিএসে পাশ করা তা হলে কোনও ‘ব্যাপারই নয়’? রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এ রাজ্যে একবার কোনও মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে পড়তে পারলে, পাশ করে বেরোনোটা নিশ্চিত। কারণ, এখানে কেউ ফেল করেন না। এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘আমরা কেউ ফেল করানোর সাহস দেখাই না। কারণ, দু’দিকেই চাপ। একদিকে ইউনিয়নের সদস্যদের হাতে মারধর খেতে হবে। অন্য দিকে, দফতরের কর্তারা চোখ রাঙাবেন। বলবেন, ‘আপনার ব্যর্থতা, আপনি পাশ করাতে পারেননি’। কী দরকার ঝামেলায় জড়ানোর? তার চেয়ে চোখ বুজে থাকাই ভাল।’’

আরও পড়ুন: মমতা এখন বিরোধী থাকলে, কী করতেন? বিরোধীরা বললেন, আর একটা মমতা চান তো!

স্বাস্থ্য ভবনকে ইতিমধ্যেই অস্বস্তিতে ফেলেছে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের একটি ঘটনা। সেখানকার কয়েক জন পড়ুয়ার হাল এতই খারাপ ছিল যে পাশ করাননি এক শিক্ষক। রাতে তাঁর কোয়ার্টার্সে গিয়ে হুমকি দেন পড়ুয়ারা—‘‘কাল সকালের মধ্যে যদি সব ঠিকঠাক না করে দেন, বর্ধমান ছাড়তে পারবেন না।’’ এখানেই শেষ নয়। পড়ুয়ারা চলে যাওয়ার পরেই আসে মোক্ষম ফোন। এ বার কলকাতা থেকে। অভিযোগ, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ এক চিকিৎসক-বিধায়ক ফোন করে বলেন, ‘‘আপনাকে পাকামি করতে কে বলেছে? একজনও যদি ফেল করে, পরিণাম ভাল হবে না।’’ এর পর আর ‘ঝুঁকি’ নেননি ওই চিকিৎসক। নিজে তো সকলকে পাশ করিয়েছেনই, চেনাজানা সকলকেও বলেছেন, ফেল করানোর ঝুঁকি না নিতে। শিক্ষক-পড়ুয়া দু’পক্ষই স্বীকার করছেন, এ ভাবেই চলছে রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষা। তৈরি হচ্ছেন ভবিষ্যতের ডাক্তাররা। শিক্ষকরা দায় নিচ্ছেন না। বলছেন, ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা থাকে না। কাকে পড়াব? আর পড়ুয়ারা বলছেন, স্যরেরা ১০টার সময় সামনের দরজা দিয়ে ঢোকেন। ১১টার সময়ে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। আবার বিকেলে ফেরেন। ওঁদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস থাকে তো! কলকাতার উপকণ্ঠে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের একাধিক ক্লাসে দুপুর ১২টা নাগাদ গিয়ে শিক্ষকদের দেখা মেলেনি। ফোন করলে তাঁদের অনেকেই বলেছেন, ‘‘একটু বেরিয়েছি।’’ যে সময় তাঁদের হাসপাতালে থাকার কথা, সে সময়ে তাঁরা ‘একটু’ বেরোন কী ভাবে? উত্তর পাওয়া যায়নি।

রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেছেন, ‘‘শিক্ষক যদি ঠিকঠাক পড়াতে পারেন, তা হলে ক্লাসে পড়ুয়ারা আসবেন না, এটা মানতে পারছি না। পড়ানোয় কোথাও কিছু ফাঁক থেকে যাচ্ছে।’’ সেই ফাঁক পূরণে সরকারের কী ভাবনা, মেডিক্যাল শিক্ষার এই বেহাল দশা হল কী করে, কীভাবেই তা কাটবে, সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেলেনি।

প্রশ্ন হল, কলেজে ক্লাস না করে পডুয়ারা পরীক্ষায় বসেন কী ভাবে? সহজ সমাধান— কোচিং সেন্টার! এমবিবিএসের পড়ুয়াদের জন্য শহরে, এমনকি, জেলাতেও এখন একাধিক কোচিং সেন্টার। মোটা টাকার বিনিময়ে সেখানে ভর্তি হয়ে রাশি রাশি নোট সংগ্রহ করেন পড়ুয়ারা।

মধ্য কলকাতায় এমনই একটি কেন্দ্রে এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া পরিচয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল। জানা গেল, শুক্র, শনি, রবি সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস। সরকারি কলেজ-হাসপাতালের একাধিক ‘মাথা’ পড়ান সেখানে। সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা। খরচ কত? ফোনের ও প্রান্ত থেকে বলা হল, ‘সেকেন্ড ইয়ার তো? এক লাখ ৪২ হাজার ৭৮০ টাকা। সাকসেস গ্যারান্টেড!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন