Noise Pollution

তাণ্ডব মাত্রাছাড়া, অথচ শব্দ ঠেকানোর যন্ত্র চলে যাচ্ছে ভিন্ রাজ্যে!

রাজ্যে শব্দদূষণ রোধের জন্য মাইক্রোফোন, লাউডস্পিকার বা অন্য যন্ত্রে সাউন্ড লিমিটর লাগানোর চিত্রটা অনেকটা এমনই।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:৪৫
Share:

পর্যাপ্ত উৎপাদন রয়েছে। রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিও। কিন্তু তা নেওয়ার লোক নেই! অথচ, পাশের রাজ্যই এখান থেকে সেই প্রযুক্তি নিয়ে যাচ্ছে। আর ১৬ বছর আগে যন্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেও বিক্রি না হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ফেলে রাখতে হচ্ছে।

Advertisement

রাজ্যে শব্দদূষণ রোধের জন্য মাইক্রোফোন, লাউডস্পিকার বা অন্য যন্ত্রে সাউন্ড লিমিটর লাগানোর চিত্রটা অনেকটা এমনই। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, শব্দদূষণ রোধের পাঠ তো তা হলে প্রতিবেশী রাজ্যের থেকে শেখা উচিত।

কারণ, প্রশাসনিক সূত্র বলছে, প্রতি বছর এ রাজ্যের তৈরি প্রায় দু’হাজার সাউন্ড লিমিটর ওড়িশায় যায়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে পুজোর মরসুমে বিক্রি হয় গড়ে মাত্র ১৫-২০টি সাউন্ড লিমিটর! ওড়িশায় সাউন্ড লিমিটর নেওয়ার জন্য সংস্থা রয়েছে, যারা ওয়েবেলের থেকে জিনিসটি নেয়। সেখানে কলকাতা-সহ এ রাজ্যে তেমন সংস্থাও তৈরি হয়নি বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। অথচ সেই ২০০৪ সালেই ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড’ (ওয়েবেল)-এর সহযোগিতায় রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সাউন্ড লিমিটর তৈরি করেছিল।

Advertisement

নির্ধারিত মাত্রা (ডেসিবেল)


• শিল্পাঞ্চল (ইন্ডাস্ট্রিয়াল)
দিন: ৭৫, রাত: ৭০
• বাণিজ্যিক (কমার্শিয়াল)
দিন: ৬৫, রাত: ৫৫
• বসতি (রেসিডেন্সিয়াল)
দিন: ৫৫, রাত: ৪৫
• শব্দহীন (সাইলেন্স জ়োন)
দিন: ৫০, রাত: ৪০
দিন: সকাল ৬টা—রাত ১০টা, রাত: ১০টা—সকাল ৬টা

বৃহস্পতিবার শহরে শব্দের মাত্রা

এলাকা শব্দমাত্রা*
• নিউ মার্কেট (বাণিজ্যিক) ৬৭.৯
• কসবা গোলপার্ক (শিল্পাঞ্চল) ৫২.৩
• বিধাননগরে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ
পর্ষদের সদর দফতর (বাণিজ্যিক) ৬৯.৩
• পাটুলি সত্যজিৎ রায় পার্ক (বসতি) ৪৪.৫
এলাকা শব্দমাত্রা*
• এসএসকেএম (শব্দহীন) ৪৬.৬
• আর জি কর (শব্দহীন) ৬৪.৫
• টালিগঞ্জ (বাণিজ্যিক) ৬৬.৬
• বাগবাজার (বসতি) ৭১.৫
• তারাতলা (শিল্পাঞ্চল) ৬৪.১

*সময়: রাত ১০টা— ১০টা ৩০ মিনিট সূত্র: রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ

সেই বছরেরই ২৭শে অগস্ট নির্দেশিকা জারি করে পর্ষদ জানিয়েছিল—‘রাজ্যের সব মাইক্রোফোন ব্যবহারকারীকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, খোলা জায়গায় মাইক্রোফোন চালাতে হলে বাধ্যতামূলক ভাবে সাউন্ড লিমিটর লাগাতে হবে। না হলে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।’কিন্তু ওয়েবেলের এক কর্তা জানাচ্ছেন, যাঁরা মাইক লাগান বা এই ধরনের কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ-সহ সংস্থার বহু বার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তার পরেও তেমন সাড়া মেলেনি।

আরও পড়ুন: বাংলায় নৈরাজ্য চললেও রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি নয়: নড্ডা

ওয়েবেলের তথ্য থেকে আরও একটি বিষয় পরিষ্কার, পুজোর মরসুম ছাড়া অন্য সময়ে সাউন্ড লিমিটর বিক্রি হয় না। সে যতই সারা বছর ধরে রাজনৈতিক মিছিল-সমাবেশ চলুক না কেন! বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, জনপ্রতিনিধিরাই যদি নিয়ম না মানেন, তা হলে সাধারণ মানুষ নিয়ম মানবেন কেন! পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘সাউন্ড লিমিটর সম্পর্কে কারও কোনও ধারণাই নেই। অথচ আইন মোতাবেক সমস্ত ধরনের শব্দযন্ত্রে এটা লাগানো বাধ্যতামূলক।’’

আরও পড়ুন: সল্টলেকে বাড়ির ছাদে কঙ্কাল, ছেলেকে খুনের অভিযোগ মায়ের বিরুদ্ধে

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, নব্বইয়ের দশকের পুজো মরসুম থেকে শব্দদূষণের মাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। এত দিন যেখানে গাড়ির হর্ন, জেনারেটর, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমের মাধ্যমে শব্দদূষণ হচ্ছিল, তার সঙ্গে যোগ হয় মাইক্রোফোন, লাউডস্পিকার ও আরও পরবর্তীকালে ডিজে-র উৎপাত। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠিত শব্দদূষণ রোধ কমিটির চেয়ারম্যান, ইএনটি চিকিৎসক দুলাল বসু জানাচ্ছেন, বিভিন্ন সময়ে করা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, শহরের বিভিন্ন মোড়ে বিশেষত সন্ধ্যার সময়ে শব্দমাত্রা ৭০-৮০ ডেসিবেলের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। আবার যেখানে উড়ালপুল রয়েছে, তার নীচের এলাকায় সেই মাত্রা ৯০ ডেসিবেল হয়েছে অনেক সময়ে। দুলালবাবুর কথায়, ‘‘সাইলেন্স জ়োনেও ৫০-৫৫ ডেসিবেল আওয়াজ পাওয়া গিয়েছে।’’

অথচ এই আওয়াজ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরিবেশ আদালতের দাওয়াই ছিল, উৎসে গিয়ে একে নির্মূল করতে হবে। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘আসলে জাতীয় পরিবেশ আদালতের বক্তব্য ছিল, সমস্ত ধরনের শব্দযন্ত্রে ইন-বিল্ট সাউন্ড লিমিটর লাগানোর ব্যবস্থা করা হোক। না হলে এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ১৯৮৬-র ১৫ নম্বর ধারা এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৬৮/২৯০/২৯১ ধারা অনুযায়ী এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’’

শব্দদূষণ নিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করা পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-র সম্পাদক নব দত্ত বলেন, ‘‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সাউন্ড লিমিটর বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। আমরা কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে বিষয়টি জানাব।’’ রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র বলেন, ‘‘শব্দদূষণ রোধের কাজ একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই কাজে পুলিশের সহায়তার প্রয়োজন।’’ পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘জাতীয় পরিবেশ আদালত যা নির্দেশ দিচ্ছে, তা সবই মেনে চলা হচ্ছে।’’

কিন্তু তা কি যথেষ্ট?

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, একেবারেই নয়। এ ক্ষেত্রে তাঁরা পরিবেশ আদালতেরই আর একটি মন্তব্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যেখানে ‘বিরক্ত’ আদালত বলছে—‘দ্য স্টেট গভর্নমেন্ট অ্যান্ড দ্য স্টেট পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড হ্যাভ মিজ়ারেবলি ফেল্ড টু এক্সারসাইজ় দেয়ার স্ট্যাটুটরি ডিউটিজ়।’

আর সে কারণেই বোধ হয়, এ রাজ্যের জন্য তৈরি হওয়া সাউন্ড লিমিটর পাড়ি দেয় ভিন্ রাজ্যে। কারণ, এখানে তা নেওয়ার লোকই যে নেই!

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন