...প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধরায়। চাতক শহরে ধারাপাত। শনিবার সন্ধ্যায়, দক্ষিণ কলকাতায়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
বিকেল থেকেই চাতকের দৃষ্টি নিয়ে বসে ছিল কলকাতা। রাতে তার গলা ভিজল বটে, কিন্তু তেষ্টা মিটল না।
শনিবার ভরদুপুরে উপগ্রহ-চিত্র দেখে অবশ্য আশা জেগেছিল আবহবিদদের অনেকের মনেই। ঝাড়খণ্ড থেকে বয়ে আসা মেঘপুঞ্জগুলি জোড়া লেগে তত ক্ষণে বিরাট আকার নিয়েছিল। কিন্তু বীরভূম, মুর্শিদাবাদ পেরোতেই বদলে যেতে থাকে মেঘপুঞ্জের গন্তব্য। কলকাতার প্রায় কান ঘেঁষে উত্তর ২৪ পরগনার উপর দিয়ে তা চলে গিয়েছে বাংলাদেশে। শেষ বেলায় বাঁকুড়ার দিকে তৈরি হওয়া কিছু টুকরো টুকরো মেঘ কলকাতাকে স্বস্তি দিয়েছে।
আজ, রবিবার সন্ধ্যায় ইডেনে আইপিএল ম্যাচ রয়েছে। বিকেলে রবীন্দ্র সদনের সামনে খোলা রাস্তায় রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। তাতে মুখ্যমন্ত্রী-সহ বিশিষ্টজনেদের থাকার সম্ভাবনা। আজও কি কলকাতায় বিকেল-সন্ধেয় ঝড়বৃষ্টি হতে পারে? হাওয়া অফিস সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না। আবহবিদেরা বলছেন, বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি রয়েছে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে রয়েছে নিম্নচাপ অক্ষরেখাও। এই পরিস্থিতিতে শুধু কলকাতা নয়, জেলাগুলিতেও ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। তবে আবহবিদেরা এ-ও বলছেন, আজ বিকেলে ঝড়বৃষ্টি যে আসবেই, এমন কথা হলফ করে বলা সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে এ দিনের মতো বৃষ্টির ছিটে, দমকা হাওয়া নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল কলকাতাকে।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা, রবিবার দুপুরে মেঘ কোথায় তৈরি হচ্ছে, তা বাতাস থেকে কতটা শক্তি নিয়ে কী চেহারা ধারণ করছে, তা উপগ্রহ-চিত্রে না দেখে কালবৈশাখীর ক্ষেত্রে কোনও নিশ্চিত আগাম বার্তা দেওয়া যায় না। এর সঙ্গে বাতাসের অভিমুখ কোন দিকে রয়েছে, সেটাও হিসেব করতে হয়। তা না হলে বিরাট চেহারার মেঘ হয়তো তৈরি হল কিন্তু তা বয়ে চলে গেল অন্য দিকে। ঠিক যেমনটা হয়েছে এ দিন। শনিবার রাতে হাল্কা বৃষ্টির পরে আলিপুর আবহাওয়া দফতরের এক বিজ্ঞানী বলছিলেন, ‘‘বীরভূম, নদিয়ায় ঝড়বৃষ্টি ঘটানো মেঘপুঞ্জ এ দিকে এলে কলকাতাকে আর আফশোস করতে হত না।’’ কিন্তু সেই মেঘ এল না কেন?
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথের ব্যাখ্যা, বজ্রগর্ভ মেঘ কোন দিকে বয়ে যাবে, তা নির্ভর করে বায়ুমণ্ডলের নিম্ন ও মধ্য স্তরের বায়ুপ্রবাহের উপরে। উত্তরবঙ্গে একটি ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে এবং সেখান থেকে একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা দক্ষিণবঙ্গের একাংশের উপর দিয়ে ওড়িশা পর্যন্ত রয়েছে। ফলে নিম্ন ও মধ্য ভাগের বায়ুপ্রবাহের অভিমুখ বাংলাদেশের দিকে রয়েছে। ফলে পশ্চিমাঞ্চলের মেঘগুলি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেও বাংলাদেশের দিকে ঘুরে গিয়েছে। আবহাওয়া দফতরের এক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘বাতাসের অভিমুখের কারণেই আবার বাঁকুড়া থেকে টুকরো টুকরো মেঘ কলকাতায় বয়ে এসেছে।’’
খাস কলকাতায় এ দিন তেমন জোরালো বৃষ্টি না হলেও উত্তর ২৪ পরগনার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘপুঞ্জের প্রভাবে উত্তর শহরতলির বেশ কিছু এলাকায় জোরালো বৃষ্টি হয়েছে। নদিয়া লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনার দিকে ঝড়বৃষ্টির দাপট ছিল আরও বেশি। এ দিন সন্ধ্যায় গাড়ি নিয়ে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাচ্ছিলেন জগদ্দলের বাসিন্দা বিধান চক্রবর্তী। কিন্তু বৃষ্টির এমন দাপট ছিল যে, সামনের সব কিছু ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। তার ফলে নৈহাটিতে জরুরি কাজে সময় মতো পৌঁছতে পারেননি তিনি। বারাসত থেকে রানাঘাট যেতে গিয়ে ঠোক্কর খেতে হয়েছে রঞ্জন দাশগুপ্তকেও।
এ বার গরমের চরিত্রটা বদলে গিয়েছিল। এপ্রিলে মাত্রাছাড়া তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়খণ্ড থেকে শুকনো গরম হাওয়া বা লু এসে জ্বলুনি ধরিয়েছিল কলকাতায়। সাগর থেকে জোলো হাওয়াও ঢুকছিল না। মে মাসের গোড়ায় গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হওয়ায় সাগর থেকে জোলো হাওয়া ঢুকতে শুরু করে। ফলে মেঘ জমে, মিলতে থাকে ঝড়বৃষ্টি। আবহাওয়া দফতরের খবর, ঘূর্ণাবর্তটি ঝাড়খণ্ড থেকে সরে গিয়ে উত্তরবঙ্গে থিতু হয়েছে। সেখান থেকে একটি অক্ষরেখা গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে ওড়িশা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। ফলে কলকাতায় ঝড়বৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি রয়েছে।
কলকাতার কপাল তুলনায় মন্দ হলেও এ দিন কপাল খুলেছে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ার মতো জেলার। বীরভূমে বিকেল চারটে নাগাদ ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। জেলার সর্বত্রই বৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে হয়েছে শিলাবৃষ্টিও। খয়রাশোলের বাবুইজোড় এলাকায় গাছ ভেঙে, বিদ্যুতের খুঁটি উল্টে, ঘর ভাঙার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাঁইথিয়া, রামপুরহাট, দুবরাজপুর, বোলপুরেও ঝড়বৃষ্টি। ঝড়বৃষ্টির জেরে তাপমাত্রাও এক ধাক্কায় অনেকটা নেমে যায়। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর, রঘুনাথগঞ্জ, কান্দি, বেলডাঙা, লালগোলা ও ডোমকলেও এ দিন ঝেঁপে বৃষ্টি হয়েছে। মিলেছে দমকা হাওয়াও। কৃষ্ণনগর, কালীগঞ্জ, হাঁসখালি, শান্তিপুর, ধুবুলিয়া, রানাঘাট ও তার আশপাশের অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে। নাকাশিপাড়ায় শিলাবৃষ্টি হয়েছে। কল্যাণী, চাকদহে রাত আটটা নাগাদ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। জোরালো বৃষ্টিতে হাসি ফুটেছে দক্ষিণবঙ্গে।