জীর্ণ: সংরক্ষণের অভাবে ভেঙে যাচ্ছে প্রাসাদ। নিজস্ব চিত্র
রাজত্ব নেই, তবে ‘রাজা’ আছে!
ধুলো জমছে প্রাসাদে। হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্য। মঙ্গলাপোতায় রাজপ্রাসাদের বাইরের কাঠামোটা দেখে বোঝার জো নেই, ভিতরটা কার্যত ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। রাজত্ব না থাকলেও অবসরপ্রাপ্ত স্থানীয় স্কুলের করণিক অরবিন্দ সিংহদেবকে এলাকায় সবাই ‘রাজা’ বলেই ডাকেন। অথচ বহু যুগ আগেই ইংরেজ আমলে তাঁর পূর্বপুরুষের রাজত্বের অবসান হয়েছিল। প্রাসাদের কিছুটা দূরে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া ইট-মাটির গাঁথনির একচিলতে বাড়িতে সপরিবারে থাকেন অরবিন্দবাবুরা।
ব্রিটিশদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেননি অরবিন্দবাবুর পূর্বপুরুষরা। বিদ্রোহী হয়ে কেউ রাজত্ব খুইয়েছেন। কেউ ইংরেজ শাসকের হাতে বন্দি হয়ে অপমানে আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবাদী স্বাধীন রাজাদের প্রাসাদটির রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই উত্তরসূরি সিংহদেবদের। কুলদেবী মা মঙ্গলার সেবার জন্য বছরে দেবসেবা বাবদ মাত্র ২,৩৮০ টাকা সরকারি ভাতা পান। ওই টাকা দিয়ে কিছু করার নেই। চোখের সামনে তিলে তিলে এক একটা ইট খসে পড়তে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অরবিন্দবাবু। তাঁর ছেলে সমরজিৎ ছলছল চোখে বলেন, “ইতিহাসের টানে মাঝে মধ্যে হাতে গোনা পর্যটকরা প্রাসাদ দেখতে আসেন। ছবি তুলে নিয়ে চলে যান।”
মেদিনীপুরের পুরাতত্ত্ব গবেষক চিন্ময় দাশ ও লোকসংস্কৃতি গবেষক মধুপ দে জানালেন, অষ্টাদশ শতকে বগড়ির অত্যাচারী শাসক খয়রামল্লকে হত্যা করে রাজ্য দখল করেন ওড়িশা থেকে আগত সামসের সিংহ। গড়বেতায় মূল প্রাসাদ হলেও তিনি মঙ্গলাপোতায় দ্বিতীয় একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। সেটিই আজকের প্রাসাদ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধিতা করার দায়ে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে সামসের সিংহের পৌত্র রাজা যাদবচন্দ্র সিংহকে বন্দি করে কলকাতায় নিয়ে যায় ইংরেজ কোম্পানির পুলিশ-পেয়াদারা।
গড়বেতায় রাজাদের মূল প্রাসাদটি কামানের গোলায় ধ্বংস হয়ে যায়। অপমানে আত্মহত্যা করেন যাদবচন্দ্র। যাদবচন্দ্রের ছেলে রাজা দ্বিতীয় ছত্রসিংহ ইংরেজদের রাজস্ব দিতে না পেরে রাজত্ব হারান। ছত্র সিংহ সপরিবারে মঙ্গলাপোতার দ্বিতীয় প্রাসাদেই আশ্রয় নেন। নায়েক-বিদ্রোহে গোপনে সাহায্য করার অপরাধে ছত্রকে বন্দি করে ইংরেজরা। দশবছর কারাবাসের পরে তিনি মুক্তি পান। ছত্র সিংহ ছিলেন শেষ স্বাধীন রাজা। ছত্র সিংহের মৃত্যুর পরে তাঁর দৌহিত্র মনমোহন সিংহ ইংরেজদের কাছ থেকে বার্ষিক তিন হাজার টাকা বৃত্তি পেতেন। মনমোহনের মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে জগজীবন সিংহকেও বার্ষিক আর্থিক বৃত্তি দেওয়া হত। জগজীবনের মৃত্যুর পরে সরকারি বৃত্তি বন্ধ করে দেয় ইংরেজরা। জগজীবনের প্রপৌত্র অরবিন্দবাবু আজও এলাকায় রাজার মর্যাদা পান। মঙ্গলাপোতার প্রাসাদে এক সময় ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের গোপন আখড়া ছিল। কয়েক বছর আগে প্রাসাদ সংলগ্ন এলাকায় মাটি খুঁড়ে কামান ও গোলাবারুদ পাওয়া গিয়েছিল।
এমন একটি ঐতিহাসিক কেন্দ্রের সংরক্ষণের জন্য সরকারের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু প্রশাসনিকস্তরে আজ পর্যন্ত মঙ্গলাপোতার প্রাসাদ ও দেবী মঙ্গলার মন্দির সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। এলাকাটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবিও দীর্ঘদিনের। বহু ভাঙাগড়া ইতিহাসের সাক্ষী মঙ্গলাপোতার সেই প্রাসাদটিই আজ ভেঙে পড়ার প্রহর গুনছে।