চোর ধরবে নল, আজব নিদান ওঝার!

নল ঠেকবে যার গায়ে, সেই না কি চোর! থানা-পুলিশ রয়েছে। রয়েছে আইন। তা সত্ত্বেও এমন আজব নিয়মেই চোর সাব্যস্ত করে জরিমানার নিদান প্রচলিত রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল

তমলুক শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৬ ০২:২০
Share:

প্রতীকি ছবি

নল ঠেকবে যার গায়ে, সেই না কি চোর!

Advertisement

থানা-পুলিশ রয়েছে। রয়েছে আইন। তা সত্ত্বেও এমন আজব নিয়মেই চোর সাব্যস্ত করে জরিমানার নিদান প্রচলিত রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে। চোর ধরার এই পদ্ধতির পোশাকি নাম ‘নল ধড়কা’। অভিযোগ, এই নিয়মেই চণ্ডীপুর থানার ব্রজলালচক গ্রাম পঞ্চায়েতের রসিকাচক গ্রামের যুবক কানাই সামন্তকে গয়না চোর ঠাওরানো হয় সম্প্রতি। কানাই সটান থানায় যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে এ বার আলোড়ন পড়েছে।

সপ্তাহখানেক আগে রসিকাচক গ্রামের বাসিন্দা পেশায় পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক মানস সামন্তের বাড়ি থেকে গয়না চুরি যায় বলে অভিযোগ। মানসবাবু চণ্ডীপুর থানায় ঘটনার অভিযোগ দায়ের করেন। যদিও পুলিশ ওই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অভিযোগ, নন্দীগ্রামের গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা পেশায় ওঝা গৌরহরি সামন্ত নল ধড়কা পদ্ধতিতে চোর ধরতে ‘ওস্তাদ’। চুরির ঘটনার কিনারা করতে গৌরহরির শরণাপন্ন হন মানসবাবু। অভিযোগ, গত ২০ জুলাই দুপুরে রসিকাচক গ্রামের শীতলা মন্দিরের সামনে কয়েক’শ গ্রামবাসীকে জড়ো করে নল চালানো হয়।

Advertisement

কী এই ‘নল ধড়কা’?

‘নল ধড়কা’ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত নল তৈরি করতে প্রয়োজন কাঁচা বাঁশ। একটি লম্বা বাঁশকে চার-পাঁচটি ফালিতে লম্বালম্বি করে কেটে নেওয়া হয়। তারপর এক একটি ফালি ফের চার-পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের এক একটি টুকরোয় কাটা হয়। এই একটি একটি টুকরোকেই বলে নল। কাঁচা বাশের হওয়ায় এই নল খুব নমনীয় ও পাতলা হয়। সহজেই ধনুকের মতো বাঁকানো যায় এই নল। ধনুকাকৃতি এই নলের দুই প্রান্ত দু’জন ধরে । আর নলের পিছনে মন্ত্র পড়তে পড়তে যান ওঝা। তিনিই নলের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁকেই বলা হয় নল-চালক।

অভিযোগ, গত ২০ জুলাই এ রকমই নল দু’জন ধরে গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় চণ্ডীপুর বাজারে সব্জি বিক্রি করে ওই রাস্তা দিয়ে সাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন কানাইবাবু। অভিযোগ, ওই নল গিয়ে কানাইয়ের গায়ে ঠেকে। সেই সময় কানাইবাবুকে গয়না চোর সাব্যস্ত করেন গৌরহরি। এরপরই স্থানীয়দের একাংশ কানাইবাবুকে মারতে উদ্যত হয় বলে অভিযোগ।

কানাইয়ের অভিযোগ, ‘‘কয়েকজনের হস্তক্ষেপে মারধরের হাত থেকে রেহাই পাই। যদিও গ্রাম কমিটির কয়েকজন ঘটনার দিন আমাকে জানান, ওই দিন সন্ধেয় আলোচনায় বসা হবে। আলোচনায় আমাকে ও বাবাকে হাজির থাকতে বলা হয়। যদিও আমরা ওই দিন সালিশি সভায় যাইনি।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘ঘটনার পরদিন থেকে আমাকে মানসের পরিবারের লোকজন হমকি দিচ্ছে, তিন লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে হবে। না হলে জমিতে চাষ দেওয়া হবে না।’’

গত ২৫ জুলাই কানাইবাবু চণ্ডীপুর থানায় মানস ও গৌরহরির বিরুদ্ধে চোর অপবাদ দেওয়া ও চাষের কাজে বাধার অভিযোগ দায়ের করেন। যদিও চণ্ডীপুর থানার পুলিশের দাবি, এ রকম কোনও অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ হলে পদক্ষেপ করা হবে। কানাইয়ের অভিযোগ, ‘‘হুমকির জেরে আমার জমিতে চাষের কাজে কেউ শ্রমিকের কাজ করতে চাইছে না। থানায় অভিযোগ জানানোর পর পুলিশ এখনও তদন্ত করতে আসেনি। আমি ও আমার পরিজনেরা নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছি।’’ হুমকির অভিযোগ মানতে নারাজ মানস। তাঁর দাবি, ‘‘গ্রামের বাসিন্দাদের পরামর্শ মেনেই নন্দীগ্রামের ওই নল-চালককে আনা হয়েছিল। তাতে কানাইকে ওই ঘটনায় জড়িত বলে জানানো হয়। এরপর গ্রাম কমিটি ওঁর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কানাইকে চাষে বাধা দেওয়ার হুমকির অভিযোগ ঠিক নয়।’’

রসিকাচক গ্রামের সিপিএম পঞ্চায়েত সদস্য তরুণ শীটের দাবি, ‘‘বাড়ি থেকে গয়না ও নগদ টাকা চুরির কথা জানান প্রাথমিক শিক্ষক মানসবাবু। চোর ধরার জন্য নল-ধড়কা আনলে উনি আমাকে সহযোগিতা করার কথা বলেন। মানসবাবুকে জানিয়ে দিই, এ সব অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কোনও মূল্য নেই। আপনি এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে জানান।’’ তরুণবাবু বলেন, ‘‘কানাই ভাল ছেলে। চাষ করে সংসার চালায়। পুরো ঘটনার কথাই কানাই আমার কাছে জানিয়েছে। বিষয়টি খুবই নিন্দনীয়। এ বিষয়ে ওকে প্রশাসনের কাছে জানাতে বলেছি।’’

এ বিষয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’-র চণ্ডীপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক সমরেন্দ্র মান্না বলেন, ‘‘চোর ধরার জন্য নল-ধড়কা পদ্ধতি ব্যবহার করা একেবারে অবৈজ্ঞানিক। আমাদের সংগঠন নল-ধড়কার বুজরুকি নিয়ে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রচার চালায়। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে যে সচেতনতার অভাব রয়েছে এই ঘটনা তার প্রমাণ।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ওই যুবককে যে ভাবে অপমান করা হয়েছে ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে প্রশাসনের তরফে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন