Right To Language

ভাষার অধিকার সুরক্ষিত কি, প্রশ্ন জঙ্গলমহলে

২০০৩ সালে সাঁওতালি ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফসিলে স্থান পায়। এ রাজ্যের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সাঁওতালি ভাষায় পঠন পাঠন হচ্ছে। কিন্তু সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি লিপিতে পঠনপাঠনের পরিকাঠামো নিয়ে সন্তুষ্ট নন আদিবাসী বিদ্বজ্জনদের একাংশ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:২৭
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

জঙ্গলমহলের আদিবাসী-মূলবাসীদের ভাষার অধিকার কি আদৌ সুনিশ্চিত? আরও একটা ভাষা দিবসে এমনই প্রশ্ন তুলছেন জঙ্গলমহলের আদিবাসী-মূলবাসী বিদ্বজ্জনরা।

Advertisement

২০০৩ সালে সাঁওতালি ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফসিলে স্থান পায়। এ রাজ্যের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সাঁওতালি ভাষায় পঠন পাঠন হচ্ছে। কিন্তু সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি লিপিতে পঠনপাঠনের পরিকাঠামো নিয়ে সন্তুষ্ট নন আদিবাসী বিদ্বজ্জনদের একাংশ। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাঁওতালি সাহিত্যিক নিরঞ্জন হাঁসদা বলছেন, ‘‘বহু মানুষ ও সংগঠনের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় করা গিয়েছে। এখনও এ রাজ্যে সাঁওতালি মাধ্যমে পঠনপাঠনের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি।’’

সরকারি স্তরে সাঁওতালি ভাষায় শিক্ষাদান হলেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীভুক্ত মুন্ডাদের ‘মুন্ডারি’ ভাষা ও ভূমিজদের ভূমিজ ভাষাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ ওই সব সম্প্রদায়ের। নয়ের দশকে ওড়িশার শিক্ষাব্রতী রুইদাস সিংনাগ ‘মুন্ডারি বাণী’ নামে লিপি তৈরি করেন। ভারত মুন্ডা সমাজের উদ্যোগে ঝাড়গ্রাম জেলায় ১৫টি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে মুন্ডারি ভাষায় পড়ানো হয়। ভারত মুন্ডা সমাজের সম্পাদক (সংগঠন) হিমাংশু সিং বলছেন, ‘‘আদিবাসী হয়েও মুন্ডারা এ রাজ্যে উপেক্ষিত। মুন্ডারি ভাষাকে রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবি করা হলেও আমাদের দাবি মানা হয়নি। অথচ জঙ্গলমহলের সাঁওতালদের পরেই মুন্ডারা দ্বিতীয় সংখ্যা গরিষ্ঠ জনজাতি। সরকারি বিরসা মুন্ডা অ্যাকাডেমিতে কোনও মুন্ডা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রাখা হয়নি।’’ ভূমিজরাও তাঁদের ভূমিজ ভাষার স্বীকৃতি ও সরকারি ভাবে ভূমিজ ভাষায় পঠনপাঠনের দাবি তুলেছে। ১৯৮২ সালে ওড়িশার শিক্ষাব্রতী মহেন্দ্রনাথ সর্দার ভূমিজ লিপি ‘অল অনল’ তৈরি করেন। কিন্তু ভূমিজদের জন্য এ রাজ্যে সরকারি স্তরে কোনও স্কুল নেই। ভারতীয় আদিবাসী ভূমিজ সমাজের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক নিত্যলাল সিং বলছেন, ‘‘ভূমিজ ভাষাকে রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতির দাবিটি আজও উপেক্ষিত। ভূমিজ ভাষার নিজস্ব লিপি রয়েছে। সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে এ রাজ্যে ২৫টি ‘অল অনল’ মাধ্যমের স্কুল চলছে। অল অনল লিপিতে সাহিত্য সৃষ্টিও হয়েছে।’’

Advertisement

ওবিসি তালিকাভুক্ত কুড়মিরা জনজাতি তালিকাভুক্তির দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন করে চলেছেন। কুড়মালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিও করে চলেছেন কুড়মিরা। যদিও এ রাজ্যের সরকার কুড়মালিকে রাজ্যের অন্যতম ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সরকারি স্তরে কুড়মালি ভাষার প্রসারের কোনও কাজই হয়নি বলে অভিযোগ। বেসরকারি উদ্যোগে অবশ্য কুড়মালি চিসই লিপি তৈরি করেছেন ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক জয়ন্ত মাহাতো। জয়ন্তের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে অবশেষে ইউনিকোড রোডম্যাপে জায়গা করে নিয়েছে কুড়মালি ভাষার লিপি ‘চিসই’। জয়ন্ত বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কুড়মালি মাধ্যমের সরকারি স্কুল চালু করার ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই স্কুল হয়নি। অল ইন্ডিয়া কুড়মালি চিসই-আ সোসাইটির উদ্যোগে পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়া জেলায় ৫২ টি বেসরকারি প্রাথমিক কুড়মালি মাধ্যম স্কুল চলছে। এর মধ্যে ১২টি স্কুলকে বাংলার শিক্ষা পোর্টালে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও আজ অবধি স্কুলগুলি কোনও সরকারি সাহায্য পায়নি। কারণ বাংলার শিক্ষা পোর্টালে কুড়মালি ভাষার কোনও অপশন নেই।’’

এ রাজ্যের ঝাড়গ্রাম জেলার পাশাপাশি ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সুবর্ণরেখার মধ্য অববাহিকা অঞ্চলের মানুষজন সুবর্ণরৈখিক ভাষায় কথা বলেন। সুবর্ণরৈখিক ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টিও হয়েছে। এই ভাষার প্রচার ও প্রসারে কাজ করছে ‘আমারকার ভাষা আমারকার গর্ব’ গোষ্ঠী। ওই গোষ্ঠীর প্রধান বিশ্বজিৎ পাল বলছেন, ‘‘বেসরকারি স্তরে মূলবাসী কবি-সাহিত্যিকরা সুবর্ণরৈখিক ভাষার চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর-১, গোপীবল্লভপুর-২, সাঁকরাইল ও নয়াগ্রাম ব্লকের বাসিন্দারা সুবর্ণরৈখিক ভাষায় কথা বলেন। গোষ্ঠীর উদ্যোগে গত চার বছর ভাষা প্রসারের কাজে সুফলও মিলেছে। এখন সাহিত্য সৃষ্টির পাশাপাশি, বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও সমাজ মাধ্যমেও সুবর্ণরৈখিক ভাষায় নানা অনুষ্ঠানও হচ্ছে।’’ বিশ্বজিৎ পাল বলছেন, ‘‘ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য হল বহুত্বের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান। তাই প্রত্যেকের মাতৃভাষার ক্ষেত্রে সরকারি স্তরে সমান দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন