সৈকত উন্নয়নে দুয়োরানি শঙ্করপুর

একটা সময় দিঘা এসে অনেকেই চলে আসতেন শঙ্করপুরে। নিরালা সৈকত, ঝাউবন আর স্নিগ্ধ প্রকৃতির আকর্ষণে পর্যটকের ভিড় জমত এই সৈকতেও। কিন্তু আপাতত শঙ্করপুর ‘দুয়োরানি’। ২০১১ সালে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিঘার উন্নয়নে একাধিক পরিকল্পনা করেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন, গোয়ার মতো হয়ে উঠবে দিঘা। রাজ্য নগরোন্নয়ন ও পর্যটন দফতরের মাধ্যমে দিঘায় অনেক কাজ শুরুও হয়েছে।

Advertisement

সুব্রত গুহ

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৬ ০১:২১
Share:

সৈকত জুড়ে কাঠের বল্লি আর বোল্ডারের ভিড়। বাম আমলে শিলান্যাস হলেও তৈরি হয়নি শঙ্করপুর বাসস্ট্যান্ড (ইনসেটে) ছবি: সোহম গুহ।

একটা সময় দিঘা এসে অনেকেই চলে আসতেন শঙ্করপুরে। নিরালা সৈকত, ঝাউবন আর স্নিগ্ধ প্রকৃতির আকর্ষণে পর্যটকের ভিড় জমত এই সৈকতেও। কিন্তু আপাতত শঙ্করপুর ‘দুয়োরানি’। ২০১১ সালে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিঘার উন্নয়নে একাধিক পরিকল্পনা করেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন, গোয়ার মতো হয়ে উঠবে দিঘা। রাজ্য নগরোন্নয়ন ও পর্যটন দফতরের মাধ্যমে দিঘায় অনেক কাজ শুরুও হয়েছে। কলকাতা-দিঘা কপ্টার সার্ভিসও চালু হয়েছে। তৈরি হয়েছে, ‘ওয়েলকাম গেট’, বিশ্ব বাংলা উদ্যান, ওয়াচ টাওয়ার। কিন্তু দিঘা থেকে কার্যত ঢিল ছোড়া দূরত্বে শঙ্করপুর সৈকতে অবহেলায় ছবি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসনের কোনও উদ্যোগ নেই। এমনকী বাম আমলের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলি নিয়ে কিছুই ভাবেনি তৃণমূল সরকার।

Advertisement

শঙ্করপুর পর্যটন কেন্দ্রের পরিকাঠামো বলতে প্রায় কিছুই নেই। আজ পর্যন্ত কোনও সরকারি বা বেসরকারি বাস আসে না এখানে। কলকাতা বা হাওড়া থেকে নির্ধারিত বাস রুট থাকলেও সে বাস আসে না শঙ্করপুর পর্যন্ত। কলকাতা থেকে উঠলে বাস নামিয়ে দেবে রামনগরের আগে চোদ্দোমাইল বাসস্ট্যান্ডে। তারপর ভরসা ট্রেকার অথবা ইঞ্জিন রিকশা। পর্যটকের সংখ্যা যে হেতু কম, তাই ঝোপ বুঝে কোপ মারতেই অভ্যস্ত চালকরাও, ইচ্ছে মতো দর হাঁকান তাঁরা। নজরদারির অভাবে সমস্যায় পড়তে হয় পর্যটকদের।

অভিযোগ, ২০১০ সাল নাগাদ শঙ্করপুরে বাসস্ট্যান্ড, দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের অফিস ঘরে শিলান্যাস হয়েছিল। বাম আমলের সেই প্রকল্প রূপায়ণে উৎসাহ দেখায়নি তৃণমূল সরকার। দিঘায় যেখানে একের পর এক পর্যটক বিনোদনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, শঙ্করপুরে তেমন কোনও ছবি নেই। ছন্নছাড়া পযর্টন কেন্দ্রে নিয়ে বিরক্ত পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। শঙ্করপুর হারাচ্ছে কৌলিন্য।

Advertisement

গত দশকে মন্দারমণি, তাজপুরের সৈকত পযর্টকদের কাছে পরিচিত হওয়ার অনেক আগেই শঙ্করপুরের নিরালা সমুদ্র পযর্টকদের টেনে আনত। একের পর এক বেসরকারি হোটেল লজ তৈরি হয়েছিল। মৎস্য দফতরের বেনফিশ ও পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য উন্নয়ন নিগমের পক্ষ থেকেও দু’টি অতিথিশালা খোলা হয়। রাজ্য মৎস্য দফতরের উদ্যোগে শঙ্করপুরেই গড়ে উঠে রাজ্যের প্রথম মৎস্যবন্দর।

কিন্তু পরিবহণের সুব্যবস্থা না-থাকায় গত কয়েক বছরে প্রায় ৭৫ শতাংশ পর্যটকের আসা কমে গেছে বলে জানিয়েছেন হোটেল মালিকরা। দিঘা শঙ্করপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও শঙ্করপুরের একটি বিলাসবহুল হোটেল মালিক অনাদি দাসের কথায়, ‘‘শঙ্করপুরে সাতটি হোটেলের মধ্যে সমুদ্রপাড়েই পাশাপাশি পাঁচটি হোটেল। তবু পর্যটন মরসুমে দিঘা, মন্দারমণিতে যখন পর্যটকদের ভীড় উপচে পড়ে তখনও এখানে হাতেগোনা কয়েকজন আসেন।’’

১৯৯১ সালে শঙ্করপুরকে দিঘা উন্নয়ন পর্ষদের অর্ন্তভুক্ত করে নতুন নামকরণ করা হয় দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ। নব্বই দশক থেকেই জলোচ্ছ্বাস আর সমুদ্র ভাঙনে শঙ্করপুর বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে থাকে। ভাঙন ঠেকাতে সে সময়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে উপকূলে ‘জিও টিউব’ বসানোর ব্যবস্থা করে পর্ষদ। কিন্তু তা কার্যত ব্যর্থ হয়। অনাদিবাবু জানান, সৈকতে বড়বড় কাঠের গুঁড়ির খাঁচা তৈরি করে বোল্ডার, বালি ঢুকিয়ে জিও টিউব পাতা হয়। কিন্তু জলোচ্ছ্বাসে জিওটিউব-সহ গোটা প্রকল্পটাই ভেস্তে যায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পের সুবিধা তো পাওয়া যায়নি, উপরন্তু গোটা সৈকতের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যায়। তাতেই কপাল পোড়ে শঙ্করপুরের।

একদিকে করের বোঝা, অন্য দিকে পযর্টকহীন শঙ্করপুরে হোটেল ব্যবসাও তেমন চলছে না। অতিথিশালা চালাতে গিয়ে ক্ষতির বোঝা না বইতে পেরে মৎস্য দফতরের বেনফিশ ও মৎস্য উন্নয়ন নিগমের অতিথিশালাগুলিকেও বেসরকারি সংস্থার হাতে লিজ দেওয়া হয়েছে বলেও সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কিছু দোকানদার, হোটেল কর্মচারীদের অভিমত, বাস যোগাযোগ চালু বলে আর চোদ্দমাইল-শঙ্করপুর রাস্তা সংস্কার করলেই পর্যটক টানা সম্ভব। সেই সঙ্গে দরকার সমুদ্রপাড়ে প্রমোদ ভ্রমণের সামান্য ব্যবস্থা। তা হলেই পুরনো তার চেহারা ফিরতে পারে শঙ্করপুর।

সৈকত পযর্টনকেন্দ্র উন্নয়নের নামে দিঘায় যখন কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে, তার সিকিভাগ টাকাও যদি শঙ্করপুরের জন্য খরচ করা হয়— এই আবেদন তাঁরা রাখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয় ইনিংসে। আশায় বুক বাঁধছেন শঙ্করপুরের হোটেল ব্যবসায়ী, কর্মচারী, ছোট ব্যবসায়ী থেকে স্থানীয় মানুষজন সকলেই।

তবে দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান তথা রামনগরের বিধায়ক অখিল গিরি বলেন, ‘‘শঙ্করপুরে কিছুই ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেই কাজ শুরু হয়েছে। রাস্তাঘাট, পথবাতি, সমুদ্রবাঁধের কাজ চলছে।’’ তাঁর দাবি, ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে সমুদ্রবাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তা শেষ হলেই সৈকতে সৌন্দর্যায়নের কাজ শুরু হবে। কাঁথি-শঙ্করপুর মেরিনড্রাইভের আদলে রাস্তার তৈরির কাজও চলছে। তা ছাড়া প্যাকেজ ট্যুরের তৈরির কথাও ভাবছে সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন