‘চিনা থাবায় রুজিতে টান’, মন ভাল নেই ছাতা সারাই গ্রামের

আকাশে কালো মেঘ। যে কোনও সময়ে নামতে পারে মুষলধারে বৃষ্টি। সকলে ফিরছেন ঘরে। কিন্তু রুজির টানে ঝড়-জল মাথায় ওঁরা বেরিয়ে আসতেন ঘর থেকে। 

Advertisement

আরিফ ইকবাল খান

হলদিয়া শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৫০
Share:

সুদিন ফিরবে কি? চিন্তায় ছাতা সারাইয়ের কারিগর। —নিজস্ব চিত্র।

আকাশে কালো মেঘ। যে কোনও সময়ে নামতে পারে মুষলধারে বৃষ্টি। সকলে ফিরছেন ঘরে। কিন্তু রুজির টানে ঝড়-জল মাথায় ওঁরা বেরিয়ে আসতেন ঘর থেকে।

Advertisement

এক সময় বর্ষায় প্রত্যেক দিনেই এঁদের দেখা মিলত হলদিয়ার চৈতন্যপুর, ব্রজলাল চকে, আন্দুলিয়া, চক শুকলালপুরের রাস্তার পাশে। ব্যস্ত থাকতেন ছাতা সারাতে। কিন্তু বর্তমানে এই সব মানুষগুলির সংখ্যাই কমে গিয়েছে। আর যাঁরা এই পেশার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা পড়েছেন সঙ্কটে। কারণ, সস্তার চিনা ছাতায় ছেয়েছে বাজার। বর্তমানে খারাপ ছাতা সারানোর বদলে, অল্প দামে নতুন ছাতা কিনছেন অধিকাংশ মানুষজন।

স্থানীয় সূত্রের খবর, হলদিয়া ব্লকের চক শুকলালপুর গ্রামের আর এক পরিচিতি ছাতা সারাইয়ের গ্রাম হিসাবে। গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা ছাতা সারাইয়ের পেশার সঙ্গে যুক্ত। এঁদের মধ্যে কারও বয়স ৯০, কারও বয়স ৮০, আবার কেউ প্রতিবন্ধী। সত্তরোর্ধ্ব বলাই দেবনাথ শারীরিকভাবে অক্ষম। তিনি এখনও ছাতা সারাইয়ের যন্ত্রপাতি নিয়ে বসেন। আর একজন হরেকৃষ্ণবাবু বলেন, ‘‘পেট চলুক বা না চলুক, এই কাজ ছাড়া আর কিছু তো শিখিনি। তাই এই কাজ ছাড়া অন্য কোনও আয়ের বিকল্প নেই।’’ একই অবস্থা অশোক দেবনাথ, রাম দেবনাথ, পঞ্চানন দেবনাথ, বলাই দেবনাথের।

Advertisement

আরও পড়ুন: ক্যালিফোর্নিয়ায় ৮০০ ফুট গভীর খাদে পড়ে মৃত্যু ভারতীয় দম্পতির

ঊর্মিলা দেবনাথ নামে এক ছাতা সারাই কর্মীর স্ত্রী বলেন, ‘‘আগে থেকে কেউ ভাঙা ছাতা মেরামতি করেন না। তাই বৃষ্টি আর আবহাওয়া খারাপ হলেই ওঁরা বেরিয়ে যান। বিয়ে হয়ে এসেই দেখেছি, গ্রামের মানুষেরা দুর্যোগ মাথায় নিয়েই বেরিয়ে যান।’’

তবে অশোক দেবনাথ নাম এক ছাতা সারাই কর্মীর আফশোস, ‘‘এখন আর আগের মত ছাতা সারাতে মানুষ আসেন না। আগে ঝড় জল বা কালবৈশাখী হলে একাধিক ছাতা পড়ত। বাবা-কাকাদের আমল থেকে এই কাজ শিখেছি। কাজ ছাড়তে চাইলেও আর পারি না।’’

ছাতা সারাইয়ের মিস্ত্রি রাম দেবনাথ ও পঞ্চানন দেবনাথ বলেন, ‘‘এখন মানুষ সস্তায় চিনা ছাতা পেয়ে যাচ্ছেন। তাই সারাতে তেমন আর আসছেন না। আগে কত ধরনের ছাতা দেখেছি। সেই সময় ছাতার লাঠি ছিল বেতের, বাঁশের আর কাঠের। সে সব ছাতার ব্যাপারই আলাদা ছিল।’’

প্রবীণ হরেকৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, ‘‘আগে কত ধরনের ছাতা আসতো। জমিদারদের ছাতার কদর ছিল আলাদা। সেই সব ছাতার কথা আজও মনে ধরে আছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ছাতা সারাই করতে করতে কত গল্প শুনতে পেতাম। এক একটা ছাতার সাথে এক একটা পারিবারিক ইতিহাস থাকত। ছাতা সারাইয়ের সে সব দিন আর নেই। এখন ছাতা সারাই করে ২০ থেকে ৩০ টাকাও মেলে না। কারণ, এখন তো ৮০-১০০ টাকায় নতুন ছাতা হাতে এসে যাচ্ছে। লোকে কেন ভাঙা ছাতা সারাবে বলুন তো!’’

প্রবীণ এই মানুষগুলি পেশার জন্য সরকারি ভাবে তেমন কিছু সাহায্য পাননি বলে অভিযোগ। তবে কি অশোক, হরেকৃষ্ণদের পরেই এই প্রজন্মের শেষ? এ ব্যাপারে হলদিয়া ব্লকের বিদায়ী সভাপতি খুকুমনি সাহু বলেন, ‘‘ছাতা সারাইয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত বয়স্ক মানুষরা আলাদা করে কোনও দিন আবেদন করেননি। ওঁরা আবেদন করলে ভেবে দেখা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন