কবিগান, তরজার ঐতিহ্য হারাচ্ছে শহর

এক সময় সন্ধ্যা হলেই শহর জুড়ে বসত গানের আসর। কবি-তরজায় জমে উঠত আটচালা। খ্যাতির জোয়ার ছিল জেলার বাইরেও। না, এ সব গৌরবের দিন ঊনবিংশ শতাব্দীর নয়। বিশ শতকের শেষ দশকেও ক্ষীরপাইয়ে নিয়মিত কবিগানের আসর বসত।

Advertisement

অভিজিৎ চক্রবর্তী

ক্ষীরপাই শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৫ ০১:১৫
Share:

নবীন সঙ্ঘের নাটকের পুরনো ছবি। —নিজস্ব চিত্র।

এক সময় সন্ধ্যা হলেই শহর জুড়ে বসত গানের আসর। কবি-তরজায় জমে উঠত আটচালা। খ্যাতির জোয়ার ছিল জেলার বাইরেও।

Advertisement

না, এ সব গৌরবের দিন ঊনবিংশ শতাব্দীর নয়। বিশ শতকের শেষ দশকেও ক্ষীরপাইয়ে নিয়মিত কবিগানের আসর বসত। ছিল যাত্রা, থিয়েটারের রমরমা। তবে খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে সে সব। আক্ষেপ
করেন প্রবীণরা।

ক্ষীরপাইয়ের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে সঙ্গীত আর সংস্কৃতি। চূড়ান্ত অবক্ষয়ের পরে বাংলা সংস্কৃতি যখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থেকেছে কবিগান, পাঁচালি বা কীর্তনের সুরে, তখনও নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে ক্ষীরপাই। শহরের রামচন্দ্র মিশ্রর বাড়িতে গানের আসর বসত। শোনা যায় সেখানে আসতেন পেডি, বার্জে বা ডগলাসের মতো ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটরাও। চলত শীতলামঙ্গল, রামায়ণ গান, ধর্মঠাকুরের পাঁচালির গান। ক্ষীরপাই পুরসভার সামনের এক আটচালায় বসত কবিগানের আসর। পৌরাণিক কথার সঙ্গে সমসাময়িক জমিদারদের নানা কীর্তি নিয়ে লড়াইয়ে নামতেন দুই কবিয়াল। কাশীগঞ্জের বৈঠকখানাতেও কবিগানের আসরে ভিড় উপচে পড়ত। মনে করতে পারেন আজকের প্রবীণরা।

Advertisement

শহরের নিতাই পাল, কার্তিক পাত্র, মদন দোলইরা কবিগানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ডাক আসত কলকাতা থেকেও। স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষীরপাই সাংস্কৃতিক চর্চার দিক দিয়ে জেলায় প্রথম সারিতে জায়গা করে নিয়েছিল। কবিগানের পাশাপাশি চলত তরজাও।

কবিয়াল নিতাই পালের বংশধরেরা আজও স্মৃতি আঁকড়ে রয়েছেন। নিতাইবাবুর ছেলে চিত্র পাল বলেন, “তখন আমি খুব ছোট। বাবা মাঝে মধ্যে নিয়ে যেতেন গানের আসরে। ভালো লাগত। কলকাতা এমনকী অন্য রাজ্যেও যেতেন। বহু পুরস্কার পেয়েছেন, গানের
রেকর্ডও রয়েছে।”

কিন্তু সে ঐতিহ্য ধরে রাখেননি নতুন প্রজন্মের কেউ। মোবাইল, ইন্টারনেটের যুগে কবিগান শোনার মানুষ কই? ফলে অর্থের টানেই অন্য পেশায় চলে যেতে চাইছেন কবিয়ালদের
পরবর্তী প্রজন্ম।

এক সময় যাত্রা, নাটকেরও রমরমা ছিল। গড়ে উঠেছিল ক্ষীরপাই বান্ধব নাট্য সমাজ। প্রশাসনও উদ্যোগী হয়ে তৈরি করেছিল নাট্যদল। আজও ক্ষীরপাইয়ের মানুষ মনে রেখেছেন বিডিও সুকুমার রায়ের কথা। ১৯৭২ সাল নাগাদ মূলত তাঁর উদ্যেগেই তৈরি হয়েছিল নবীন সঙ্ঘ-সহ একাধিক
থিয়েটার দল।

শান্তি পাহাড়ির উদ্যোগে ‘প্রগতিশীল নাট্য সংস্থা’ তৈরি হয়েছিল। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে সামাজিক, ঐতিহাসিক নানা কাহিনী পরিবেশন করতেন তাঁরা। যাত্রাতেও খ্যাতি ছিল শহরের। স্থানীয় যতীন্দ্রনাথ পান, হৃষিকেশ হালদারেরা যাত্রার দল তৈরি করেন। সে সময় ক্ষীরপাই ছিল হুগলি জেলার একটি মহকুমা।

সবচেয়ে বেশি কদর ছিল পৌরানিক যাত্রার। সে সব দিনের ইতিহাস বুকে নিয়ে এখনও রয়ে গিয়েছে যাত্রার নানা রকম পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র, মঞ্চসজ্জার নানা উপকরণ। শহরের দশ নম্বর ওয়ার্ডের চৌকান এলাকায় যতিন্দ্রনাথ পানের বাড়িতে এখনও গচ্ছিত রয়েছে সে সব। কিন্তু কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে কেউ।

এমনকী শহর কলকাতায় যখন থিয়েটাের পুর্নর্জাগরণ হচ্ছে, জেলায় জেলায় লেগেছে তার ঢেউ। ছোট বড়, যার যতটুকু সাধ্য নাট্যাভিনয়ের চেষ্টা করছে বিভিন্ন দল। কিন্তু ক্ষীরপাইয়ে তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

তবু খানিকটা বেঁচে আছে কীর্তনের আসর। শহরের দয়াবাজারে শক্তি দোলই, নিমাই মণ্ডল-সহ অনেকেই এখনও কীর্তনের দল রয়েছে। শক্তি বাবু বলেন, “আসলে এখনকার ছেলে-মেয়েরা আর এই পেশায় আসতে চাইছে না। যার জন্য আমাদের এই শহরের বেশ নাম ছড়িয়ে ছিল, আগ্রহ এবং অন্য পেশায় সব চলে যাওয়ায় কতদিন আর এটিকে টিঁকিয়ে রাখতে পারব-বুঝতে পারছি না।”

অবশ্য এই ছোট শহর থেকেই এখন অন্যযুগ, পল্লী প্রচার, সত্য পথের যাত্রীক পত্রিকা গুলি নিয়মিত প্রকাশ হয়। শহরে এখন সাহিত্য সভাও হয়। প্রতিমাসের তৃতীয় রবিবার শহরের কদমকুণ্ডু মোড়ে একটি ক্লাবে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, কবিতা পাঠ, গানের আড্ডাও হয়। এখন অবশ্য শহরের মানুষ অনেকটাই ঘরমুখী। পার্ক থাকলেও বাচ্চাদের আকর্ষণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। শহরে একটি সিনেমা হল থাকলেও সেখানকার পরিবেশও স্বাভাবিক নয় বলে অভিযোগ।

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর ক্ষীরপাই’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন