বৃদ্ধা খুনে ডাইন-তত্ত্ব

শনিবার সকালে সরলার ছেলে কালীপদ মাণ্ডি বলেন, ‘‘আমি ও মা ঘরে থাকতাম। আমার অনুপস্থিতির সুযোগে কাল সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ আমাদের প্রতিবেশী মায়ের ভাইপো হপন মাণ্ডি-সহ কয়েকজন এই কাজ করেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

চন্দ্রকোনা রোড শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২৩:১৭
Share:

তাঁতিচুয়া গ্রামে নিহতের বাড়ির সামনে ভিড় করেছেন আতঙ্কিত পড়শিরা। ছবি: রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য

হাঁসুয়ার কোপে বাড়িতেই খুন হলেন এক আদিবাসী বৃদ্ধা। তাঁর ছেলের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার হয়েছেন বৃদ্ধার ভাইপো। ডাইন অপবাদ দিয়েই বৃদ্ধাকে খুন করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান। শুক্রবার ভরসন্ধ্যায় গড়বেতা ৩ অর্থাৎ চন্দ্রকোনা রোড ব্লকের শঙ্করকাটা পঞ্চায়েতের তাঁতিচুয়া গ্রামে নিহতের নাম সরলা মাণ্ডি (৬০)। দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে।

Advertisement

শনিবার সকালে সরলার ছেলে কালীপদ মাণ্ডি বলেন, ‘‘আমি ও মা ঘরে থাকতাম। আমার অনুপস্থিতির সুযোগে কাল সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ আমাদের প্রতিবেশী মায়ের ভাইপো হপন মাণ্ডি-সহ কয়েকজন এই কাজ করেছে। শৌচাগারে যাওয়ার সময় মা-কে একা পেয়ে প্রথমে ওরা মারধর করে। তারপর হপন মাকে হাঁসুয়া দিয়ে মারে।’’ কালীপদের দাবি, তিনি ফিরে দেখেন সরলা পড়ে আছেম। মৃত্যুর আগে তিনি ‘হপনরা মেরেছে’ বলেও যান।

কিন্তু কেন এই খুন?

Advertisement

কালীপদ বলেন, ‘‘হপনরা মাকে ডাইন ঠাওরেছিল। ওদের এক ছেলে গত বছর দুর্গাপুজোর আগে সাপের কামড়ে মারা যায়। গুনিন বলেছিল ডাইন মেরেছে। তারপর আমার বউও কয়েকমাস আগে মা-কে ডাইন বলে মারধর করে বাপের বাড়িতে চলে যায়। সেই থেকে মা-কে ডাইন অপবাদে হেনস্থা করা হত।’’ কালীপদের অভিযোগের ভিত্তিতে হপনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শনিবার ধৃতকে গড়বেতা এসিজেএম আদালতে হাজির করা হলে ৫ দিন পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ হয়েছে।

ব্লক শহর চন্দ্রকোনা রোড থেকে গ্রামের দূরত্ব মেরেকেটে ৫ কিলোমিটার। ৯৪টি আদিবাসী পরিবারের বাস এই তাঁতিচুয়ায়। গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশু শিক্ষা কেন্দ্র, জুনিয়র হাইস্কুল রয়েছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা সেখানেই পড়াশোনা করে। গ্রামে পাইপ লাইনের পানীয় জল, বিদ্যুৎ সব সুবিধাই রয়েছে। অল্পবয়সীদের হাতে হাতে অ্যানড্রয়েড ফোনেরও দেখা মিলল। গ্রামে ঢোকার মুখে আড্ডায় বসা কয়েকজন তরুণ সেই আধুনিক ফোনের হেডফোন কান থেকে খুলে বলল, ‘‘কী একটা ঘটেছে বলে শুনছিলাম। পুলিশ এসেছিল। আর কিছু জানি না।’’

এমন গ্রামেও মানুষের মনে ডাইনের বাসা! প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে শিক্ষাতেও কি দূর হচ্ছে না কুসংস্কারের আঁধার!

‘নির্মল ব্লক’-এর তকমা পাওয়া গড়বেতা ৩-এর বিডিও অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘‘এটাই সব থেকে উদ্বেগজনক। তাঁতিচুয়া গ্রামে আদিবাসী সমাজে ডাইন অপবাদে খুনের ঘটনায় পুলিশ দ্রুত হস্তক্ষেপ করে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। আমিও বিজ্ঞান কর্মীদের সাথে কথা বলেছি। এলাকায় বিজ্ঞানভিত্তিক প্রচারের ব্যবস্থা করছি।’’

শনিবার সকালে তাঁতিচুয়া গ্রামের উপর পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, নিহত মহিলার অ্যাসবেস্টসের ঘরে তালা ঝুলছে। বাইরে জিনিসপত্র লন্ডভন্ড। পাশেই বছর চারেক আগে পঞ্চায়েত থেকে ইন্দিরা আবাস যোজনায় পাওয়া ছেলে কালীপদের ইটের ঘর, সেটাও লন্ডভন্ড। ঠিক তার পিছনেই অভিযুক্ত হপনের ঘর। হাপুস নয়নে কাঁদছেন হপনের স্ত্রী কল্পনা ও দশম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে পম্পা। কল্পনা বলেন, ‘‘কী হয়েছে জানি না। ও (স্বামী) তো ঘরে ঘুমোচ্ছিল। রাতে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেল।’’

ঘটনা নিয়ে মুখে কুলুপ প্রতিবেশীদেরও। কয়েকজন আদিবাসী মহিলা শুধু জানালেন, একবছর আগে হপনের ১৩ বছরের ছেলে সাহেবকে সাপে কামড়ালে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েওও বাঁচানো যায়নি। তারপর একদিন সবাই মিলে বহুদূরে এক গুনিনের কাছে গেলে সে বলে, ‘ওকে ডাইনে খেয়েছে’। তারপর পাড়ার আরও দু’জন পুরুষ রোগজ্বালায় মারা গিয়েছিল। তবে ডাইন ঠাওরে গ্রামে কোনও সালিশি হয়নি।

কালীপদের অবশ্য অভিযোগ, ‘‘মা-কে ডাইন বলে গ্রামের কয়েকজন মাঝেমধ্যেই আলোচনা করত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন