ঘরে চাল নেই, ত্রাণের লাইনে লক্ষ্মীদেবীরা

অভাবের সংসারে কোনওমতে দিন গুজরান। পুকুর থেকে গেড়ি-গুগলি তুলে বাজারে বিক্রি করে সামান্য আয় হয়। তিন ছেলে-সহ আট জনের সংসারে সেই আয় আর কতটুকু। তবুও তিনদিনের রোজগারের টাকা জমিয়ে শখ করে গত মাসেই একটা কাঁসার থালা কিনেছিলেন ঘাটালের কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কানন দাস।

Advertisement

অভিজিৎ চক্রবর্তী

ঘাটাল শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৫ ০২:২৬
Share:

লক্ষ্মী দোলই এবং কানন দাস।—নিজস্ব চিত্র।

অভাবের সংসারে কোনওমতে দিন গুজরান। পুকুর থেকে গেড়ি-গুগলি তুলে বাজারে বিক্রি করে সামান্য আয় হয়। তিন ছেলে-সহ আট জনের সংসারে সেই আয় আর কতটুকু। তবুও তিনদিনের রোজগারের টাকা জমিয়ে শখ করে গত মাসেই একটা কাঁসার থালা কিনেছিলেন ঘাটালের কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কানন দাস। শনিবার রাত থেকেই জল বাড়ছিল। সকাল হলেই সব জিনিস গুছিয়ে ফেলতে পারবেন, এই বিশ্বাস নিয়েই নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গিয়েছিলেন কাননদেবী। রবিবার সকালের মধ্যেই যে বাড়িতে জল ঢুকে যাবে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি। জলে বাড়ির অর্ধেক অংশ ডুবে গিয়েছে। ভেসে গিয়েছে সাধের কাঁসার থালাও। হন্যে হয়ে খুঁজেও থালার সন্ধান পাননি তিনি। কাননদেবীর কথায়, “বাড়িতে এত তাড়াতাড়ি জল ঢুকে গেল, যে আমার সাধের কাঁসার থালাটাও খুঁজে পেলাম না।’’

Advertisement

বাড়ি থেকে ত্রাণ শিবিরে যাওয়ার সময় রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, সোনার দুল ও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস একটি ব্যাগে ভরে বাড়ির ছাদে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে এসেছেন তিনি। জল আরও বাড়লে কী হবে? কাননদেবী বলেন, ‘‘বাড়ির ছাদ পর্যন্ত জল উঠলে ওপারের নদীর বাঁধ ভেঙে যাবে। আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলছে। তাই ওই ব্যাগ নিয়ে আমার চিন্তা নেই।’’ শুধু কাননদেবী নন, রবিবার সকাল থেকেই কৃষ্ণনগরের দুলের পাড়ার প্রায় সব পরিবারই সংলগ্ন একটি পুর বাজারে আশ্রয় নিয়েছে।

কাননদেবীর মতো দুর্বিষহ অবস্থা ঘাটালের আজবনগের এক প্রৌঢ়া লক্ষ্মী দোলইয়ের। বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে। শুক্রবার থেকে পড়শি মিতা দোলইয়ের বাড়িতে থাকছেন লক্ষ্মীদেবী। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও ভাবে বেঁচে রয়েছি। দু’বেলা খাবারও জুটছে না। চাল রয়েছে, কিন্তু রান্না করব কী করে। কেরোসিন তেলই তো নেই।’’ স্থানীয়দের মুখেই শুনেছিলেন মন্ত্রী আসছেন। তিনি চাল ও রান্নার নানা সামগ্রী বিতরণ করবেন। তড়িঘড়ি নৌকোয় করে ও পায়ে হেঁটে ঘাটাল শহরের তিন নম্বর চাতালের উড়ালপুলের উপরে সকাল থেকেই লক্ষ্মীদেবী লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে সরকারি কিট না জুটলেও তৃণমূলের বিলি করা চাল ও আলু নিয়েই খুশি তিনি। রান্না করবেন কী ভাবে? প্রশ্নের উত্তরে লক্ষ্মীদেবী বলেন, ‘‘এই দিয়েই দু’দিন চলে যাবে। বাড়ি গিয়ে ছেলে-বউদের দিয়ে দেব। ওরাই রান্না করে খাবার দেবে বলেছে।’’ লক্ষ্মীদেবীর ছেলে পেশায় মজুর রবীন্দ্রনাথ দোলই বলেন, “নদীর বাঁধে রান্না করছি। কিছু কাঠ রয়েছে। তাই দিয়েই যতদিন চলে। আর কী করব?’’

Advertisement

শুধু কাননদেবী বা লক্ষ্মীদেবী নন, ঘাটাল মহকুমার বিভিন্ন ব্লকের জলমগ্ন এলাকার মানুষই দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ঘাটালের দৌলতচকের বাসিন্দা বৃদ্ধ হরিরাম প্রামাণিক বাড়িতে একাই থাকেন। তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছেন। এক ছেলে সোনার কাজের জন্য অন্যত্র থাকেন। তিনিও এ দিন ত্রাণের জন্য ঘাটালে আসেন। ব্লক অফিস থেকে চাল-আলু, ত্রিপল নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তিনি বলেন, “বাড়ি জলে ডুবে গিয়েছে। গ্রাম ছেড়ে নদী বাঁধের উপর ত্রিপল খাটিয়ে রাত কাটিয়েছি। শনিবার রাতে খাবার জোটেনি। এখন সব কিছু পেলেও কী ভাবে রান্না করব, তাই চিন্তা করছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কখন যে দু’মুঠো খাবার জুটবে জানিনা। কী আর করব! এ ভাবেই বাঁচতে হবে।’’ হরিরামবাবু এ দিন সঙ্গে করে একটি ব্যাগ নিয়ে এসেছিলেন। ব্যাগে একটি ব্যাঙ্কের পাশবই, রেশন কার্ড ও ভোটার কার্ড-সহ শ’দুয়েক টাকাও রয়েছে।” তাঁর কথায়, “এ সবই আমার সম্বল। তাই এগুলো হাতছাড়া করিনি!”

জলমগ্ন ঘাটালের দশটি পঞ্চায়েত এলাকায় দেখা দিয়েছে পানীয় জলের সঙ্কটও। বিপর্যস্ত বিদ্যুৎ পরিষেবা। জলের তলায় শৌচালয়ও। ঘাটালের মনসুকার রীতা মণ্ডল গর্ভবতী। রীতাদেবী বাড়িতে থাকলেও পানীয় জলের সঙ্কটে সমস্যায় পড়েছেন। রীতাদেবীর কথায়, ‘‘কী আর করব। বাধ্য হয়ে অস্বচ্ছ জলই ব্যবহার করছি। ভাগ্যে যা আছে, তা হবে।’’

কাননদেবীও আশা করে রয়েছেন, ভাগ্যের ফেরে যদি সাধের কাঁসার থালার খোঁজ মেলে।

ঠাঁই নেই ত্রাণ শিবিরে, আশ্রয় রেল স্টেশনে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন