পরিদর্শন: ভূগোল বিভাগের ছাত্রীদের সমীক্ষা। নিজস্ব চিত্র
গাছ কাটা রুখতে প্রচারের অন্ত নেই। তারপরেও অবশ্য ফেরেনি সচেতনতা। যথেচ্ছ গাছ কাটার ফলে স্থানীয়দের জীবনজীবিকা ব্যাহত হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। কলেজের ক্ষেত্র সমীক্ষায় উঠে এল এমনই তথ্য। সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামের একাধিক এলাকায় এই সমীক্ষা চালান মেদিনীপুরের রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্রী এবং শিক্ষকেরা। জঙ্গলমহলে যথেচ্ছ গাছ কাটা যে এখনও চলছে তাও জানা গিয়েছে সমীক্ষায়।
কলেজের ভূগোল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রভাতকুমার শীট মানছেন, “মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের একাধিক এলাকায় আমরা সমীক্ষা চালিয়েছি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি। গাছ কাটা চলছে এবং গাছ কাটার ফলে তাঁদের অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে বলে স্থানীয়রাই আমাদের জানিয়েছেন।” প্রভাতবাবুর কথায়, “গাছ কাটার ফলে স্থানীয়দের জীবনজীবিকা ব্যাহত হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এটা স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে আশঙ্কারই।” তিনি বলেন, “বিষয়টি আমরা বন দফতরেও জানাব।”
কলেজ সূত্রে খবর, সমীক্ষক দল দেখেছে, সবথেকে বেশি কাটা পড়ছে শালগাছই। অথচ, শালগাছ অনেক মূল্যবান। স্থানীয়দের অনেক কাজে লাগে। বনভূমি ধ্বংসের কারণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর তার প্রভাব নিয়েই ওই সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষক দলের বক্তব্য, জঙ্গলমহলে আদিবাসী মানুষের বসবাসই বেশি। আদিবাসী মানুষের বেশিরভাগই আবার অরণ্যের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। জঙ্গল থেকে শালপাতা, জ্বালানি কাঠ, ডালপালা, গাছের ছাল প্রভৃতি সংগ্রহ করে। প্রভাতবাবু বলেন, “আমরা দেখেছি, সংগৃহীত বনজ সম্পদের ৭০- ৮০ শতাংশ বাড়ির প্রয়োজনে ব্যবহার করেন স্থানীয়রা। আর বাকি ২০-৩০ শতাংশ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে কিছু অর্থ উপার্জন করেন। এই অর্থ খরচ করে সংসার চালানোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনেন।”
সমীক্ষক দলের বক্তব্য, অরণ্য শুধুমাত্র মানুষের আর্থসামাজিক জীবনজীবিকা বহন করে তা নয়। ভূমিক্ষয় রোধ, তাপ ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজও করে। একটি শালগাছের দাম সেই অর্থে এক বছরে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। প্রভাতবাবুর কথায়, “অথচ শুধুমাত্র কাঠের ওজন ও কাঠের মানের উপর নির্ভর করে অরণ্য ধ্বংস করা হচ্ছে। এটা উদ্বেগেরই। ৪০- ৬০ সেন্টিমিটার পরিধির ১২ ফুট শাল কাঠের দাম মাত্র ৪০ টাকা। ১৬ ফুটের দাম ১২৫ টাকা। ২০ ফুটের দাম ২০০ টাকা। বনভূমি ধ্বংসের কারণে স্থানীয় জলবায়ুও পরিবর্তন হচ্ছে।”
সমীক্ষক দলের বক্তব্য, সাম্প্রতিক বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণাতেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বনভূমি ধ্বংসকে দায়ী করা হয়েছে। যে সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২০ সাল থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলীয় গড় তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের একটা বড় এলাকা জুড়েই রয়েছে জঙ্গলমহল। অশান্তির জেরে এক সময় এখানে প্রচুর গাছ কাটা পড়েছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী যথেচ্ছ গাছ কেটে অবৈধ ভাবে কাঠ পাচার করেছে। সেই সময় জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা কাজ করতে পারেননি। ফলে ঠিক মতো নজরদারি চালানো সম্ভব হয়নি। বন দফতরের দাবি, এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। মেদিনীপুরের ডিএফও রবীন্দ্রনাথ সাহা বলেন, “অবৈধ ভাবে গাছ কাটার অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিই।”
জেলার এক বনকর্তার কথায়, “বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু এলাকায় গাছ কাটা হতে পারে। তা আটকাতে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।” তাঁর কথায়, “আমাদের সকলেরই উচিত, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সবুজকে রক্ষা করা। সবুজকে আগলে রাখা। ভবিষ্যত প্রজন্ম ও মানব সভ্যতা রক্ষার জন্যই আরও বেশি করে সবুজকে রক্ষা করা জরুরি।” তাঁর কথায়, “সবুজ কমলে সমাজের ক্ষতি। মানুষের ক্ষতি। কারণ, সেই ক্ষেত্রে আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন হবে। তা হচ্ছেও। এখন তাই আরও বেশি করে গাছ লাগানোর চেষ্টা হয়।” তাঁর সংযোজন, “জঙ্গল আমাদের সম্পদ। একে রক্ষা করতেই হবে।”