শিল্প নেই, তালুক ঘেরা নীল পাঁচিলে

লোকসভার যুদ্ধে জরুরি বিধানসভার অঙ্ক। সেই সমীকরণেই আনন্দবাজার পৌঁছে গিয়েছে জনতার দরবারে। তিন বছর আগের ভোটের পরে কী পেয়েছেন মানুষ, সাংসদ নির্বাচনের আগেই বা কী ভাবছেন তাঁরা, রইল বিধানসভাওয়াড়ি পর্যালোচনা। পালাবদলের পরে তৃণমূল সরকার গোয়ালতোড়ে উৎপাদন শিল্পতালুক (ম্যানুফ্যাকচারিং হাব) গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে। পুরো তালুকটির নকশা তৈরি হয়েছে।

Advertisement

বরুণ দে

শালবনি শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০১:১৫
Share:

পাঁচিলের কাজও শেষ হয়নি শিল্পতালুকের। নিজস্ব চিত্র

নীল রং করা ঝকঝকে পাঁচিলের পাশে ভাঙাচোরা রাস্তা যেন কিছুটা বেমানান। এই পাঁচিল প্রস্তাবিত শিল্পতালুকের।

Advertisement

পালাবদলের পরে তৃণমূল সরকার গোয়ালতোড়ে উৎপাদন শিল্পতালুক (ম্যানুফ্যাকচারিং হাব) গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে। পুরো তালুকটির নকশা তৈরি হয়েছে। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি বলছিলেন, ‘‘প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত জমিটি শিল্পস্থাপনের উপযোগী। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল।’’ এলাকার মানুষের অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্য। অনেকেরই মন্তব্য, খানাখন্দ পেরিয়ে এখানে কখনও শিল্প আসে! অজিত অবশ্য বলছেন, ‘‘এত বড় কাজ তো আর এক- দু’দিনে হয় না। ধীরে ধীরে পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে।’’ রাস্তায় দেখা হরেকৃষ্ণ মাহাতো, সুদর্শন মাহাতোদের সঙ্গে। হরেকৃষ্ণরা বলছিলেন, ‘‘কারখানা হবে বলে তো কত বছর ধরেই শুনছি। কিছুই তো আর হচ্ছে না।’’

স্থানীয় দুর্গাবাঁধে সরকারি বীজ খামারে জমি ছিল প্রায় ৯৫০ একর। এই জমিকেই শিল্পের কাজে লাগাতে চাইছে তৃণমূল সরকার। পূর্বতন বাম সরকার জিন্দল গোষ্ঠীর ইস্পাত-লগ্নি আনতে চেয়েছিল শালবনিতে। শেষমেশ ইস্পাত হয়নি, হয়েছে সিমেন্ট। গোয়ালতোড়ে অবশ্য এখনও কোনও কারখানাই হয়নি। এলাকার অনেকে দিনমজুরি করেন। বিজেপির জেলা সভাপতি শমিত দাশের কটাক্ষ, ‘‘কোথায় শিল্প? শুধু চমক। সব তৃণমূলের ভাঁওতা!’’

Advertisement

২০১৬ সালের বিধানসভায় যেখানে বিজেপি পেয়েছিল প্রায় ১২ শতাংশ ভোট, সেখানে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে বিজেপি পেয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ গেরুয়া-শিবিরের ভোট বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে তৃণমূল। গত বিধানসভায় তৃণমূলের শ্রীকান্ত মাহাতো পেয়েছিলেন ১,২০,৪৮৫ ভোট। সিপিএমের শ্যাম পাণ্ডে পেয়েছিলেন ৬৭,৫৮৩ ভোট। বিজেপির ধীমান কোলে পেয়েছিলেন ২৩,৯৬৫ ভোট। এ বার পঞ্চায়েতে গোয়ালতোড়ের ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ৩টি, বিজেপি ৩টি। চন্দ্রকোনা রোডের ৮টির মধ্যে সবক’টিই তৃণমূলের। শালবনির ৫টির মধ্যে তৃণমূলের ৩টি, বিজেপির ২টি।

শালবনির বিধায়ক শ্রীকান্তের স্ত্রী অঞ্জনা মাহাতো ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। স্ত্রীকে জেতাতে সেখানেই ঘাঁটি গেড়েছেন শ্রীকান্ত। শালবনিতে প্রচারের কাজ সামলাচ্ছেন নেপাল সিংহ, উত্তরা সিংহ, আশিস চক্রবর্তীরা। ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে জেলা সভাধিপতি উত্তরা রোজই পাড়া বৈঠক করছেন। দলের ব্লক সভাপতি নেপাল বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন। শ্রীকান্ত ভীমপুর পঞ্চায়েতের বাসিন্দা। এক সময় পঞ্চায়েত প্রধানও ছিলেন তিনি। বাম-আমলে দু’বার এই গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছিল তৃণমূল। একবার ’৯৮ সালে। আরেকবার ২০০৮ সালে। সেই ভীমপুর পঞ্চায়েত এ বার তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছে। শ্রীকান্তর পাড়াতেও গেরুয়া- শিবিরের দাপট বেড়েছে।

শ্রীকান্তের বাড়ির গ্রাম ভীমপুরের কয়মায় দেখা ৭৯ বছরের প্রাণকৃষ্ণ মাহাতোর সঙ্গে। প্রাণকৃষ্ণ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। এক সময়ে তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি ছিলেন। সেটা ২০০৭ সাল। তাঁর হাত ধরেই ২০০৮ সালের পঞ্চায়েতে এখানে জিতেছিল তৃণমূল। এখন ‘বসে’ গিয়েছেন তিনি। বিধায়কের পাড়ায় এত পদ্মফুলের চাষ হল কী করে? প্রাণকৃষ্ণ বলছিলেন, ‘‘এই সময়ের মধ্যে এমন সব নেতা তৈরি হয়েছে, যারা অঞ্চলটাকে জ্বালিয়ে দিয়েছে! মানুষ বাধ্য হয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মানুষের মনে হয়েছে, আগে এদেরকে তাড়াতে হবে। তারপর যে আসে আসুক।’’ প্রাণকৃষ্ণ অবশ্য এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থক। তবে কেন ‘বসে’ গিয়েছেন? বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘‘কী করব? বসে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম বলে আমাকে চক্রান্ত করে সরানো হয়েছে।’’ গোয়ালতোড়ের বোলবান্দিতে দেখা এক দিনমজুর মহিলার সঙ্গে। সরকারি প্রকল্পে বাড়ি পেয়েছেন? মহিলা বলেন, ‘‘পেয়েছিলাম একটা। অর্ধেক টাকা দিয়েছিল। অর্ধেক দেয়নি। পরে পার্টির লোককে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তাই আর বাড়িটা তুলতে পারিনি।’’

স্ত্রীকে জেতাতে জামশেদপুরে পড়ে রয়েছেন, শালবনির ‘গড়’ অক্ষত থাকবে তো? শ্রীকান্ত বলেন, ‘‘জঙ্গলমহলে কতখানি উন্নয়ন হয়েছে সেটা এলাকার মানুষ ভালই জানেন। মানুষ তৃণমূলের পাশেই রয়েছেন। আর আমি তো এই সেদিনও শালবনিতে প্রচারে গিয়েছিলাম।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন