মগ্ন: গাছের পরিচর্যায় শচীনন্দন। নিজস্ব চিত্র
অসমের বাসিন্দা যাদব পেয়ং এবং পাঁশকুড়ার প্রত্যন্ত পশ্চিম চিলকা গ্রামের শচীনন্দন সামন্ত এক অন্যেকে দেখেননি কখনও। কিন্তু দু’জনের কাজে মিল অদ্ভূতভাবে। প্রথম জন ব্রহ্মপুত্র নদের চরে কয়েক দশক ধরে গাছ লাগিয়ে তৈরি করেছেন ঘন অরণ্য। অন্য জন অরণ্য তৈরি করতে পারেননি এখনও। তবে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শচীনন্দন কংসাবতী নদীর পাড়ে গাছ লাগিয়ে আসছেন কয়েক দশক ধরে। নিজের বেতন থেকে পেনশনের টাকা, সবই ঢেলে দিয়েছেন গাছের সেবায়।
১৯৬১ সালে ময়নার রামচন্দ্র রাইসুদ্দিন হাইস্কুলে করণিক হিসাবে যোগ দেন শচীনন্দন সামন্ত। জানালেন, ১৯৬৮ সাল থেকে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে স্কুল চত্বরেই শুরু হয় তাঁর সবুজ অভিযান। ১৯৭১ সালে ওই স্কুলেই বাংলা বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন শচীবাবু। আরও জোরকদমে শুরু হয় তাঁর ‘সবুজ চর্চা’।
শচীবাবুর বাড়ির সামনে বয়ে গিয়েছে কংসাবতী। তাঁর চেষ্টায় নদীর দুই পারে সার দিয়ে মাথা তুলেছে মহানিম, আম, ছাতিম, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বট, অশ্বত্থ। কোনওটার বয়স পঞ্চাশ, কোনওটার চল্লিশ। শুধু গাছ লাগিয়েই দায় সারেননি এই বৃক্ষপ্রেমী। তিনি জানান, গাছের চারপাশে বেড়া দেওয়া, জল, সার ইত্যাদি দিয়ে গাছের বয়স দু’বছর হলে তিনি ‘মুক্তি’ নেন তার পরিচর্যা থেকে। বর্তমানে ওই কাজে সাত-আট জন স্থানীয় বাসিন্দাকে নিয়োগ করেছেন তিনি। প্রত্যেকের বেতন, খাওয়া খরচ— সবই শচীবাবুর। গাছ লাগানোর ব্যাপারে সচেতন করতে লিফলেট ছাপিয়ে এখনও তা বিলি করেন ৭৫ বছরের এই বৃদ্ধ।
শচীনন্দনের কথায়, ‘‘আমার স্ত্রী লক্ষ্মী সামন্তের প্রথম দিকে গাছের পিছনে এই টাকা খরচে আপত্তি ছিল। পরে গাছপাগল স্বামীর বৃক্ষপ্রেমে উনিও জড়িয়ে পড়েন।’’ লক্ষ্মীদেবী বলেন, ‘‘বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে স্বামী ডাক পান। উদ্যোক্তাদের কাছে তাঁর একটাই শর্তই থাকে যে, তিনি গিয়ে এলাকায় গাছ লাগাবেন।’’ তাঁর বৃক্ষপ্রেমের কথা জেনে ১৯৯৯ সালে ‘অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড ইকো ডেভলপমেন্ট বোর্ড’ থেকে দুই সদস্যের এক প্রতিনিধি দল কাজ দেখতে এসেছিলেন বলে দাবি শচীনন্দনের। ২০০২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে ‘ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমিত্র’ পুরস্কারে ভূষিত করে। নিজের জেলার বিভিন্ন সংস্থা থেকে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন এই বৃক্ষপ্রেমী।
শচীবাবুর ওই ‘সবুজ প্রেম’ প্রসঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা তথা জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক নির্মলচন্দ্র মাইতি বলেন, ‘‘শচীবাবু আমার স্কুল চত্বরেও বহু গাছ লাগিয়েছেন। একটা মানুষ গাছকে ভালবেসে জীবনের সঞ্চয় খরচ করছেন, এমন উদাহরণ কমই রয়েছে।’’ আর শচীবাবুর কথায়, ‘‘আমি গাছ ভালোবাসি। কেউ গাছ কাটলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। প্রকৃতির ঋণ আমরা কেউ শোধ করতে পারব না। তাই গাছ লাগায়েই যাব।’’