রতন দাসের দেহ।
বদায়ূঁর ছায়া এ বার নন্দকুমারেও। বৃহস্পতিবার গাছের ডাল থেকে উদ্ধার হল স্কুলপড়ুয়া এক বালিকার দেহ।
বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বছর আটেকের মেয়েটি মায়ের কাছে খেতে চেয়েছিল। ঘরে খাওয়ার মতো কিছুই ছিল না। মা তাই মেয়ের হাতে টাকা গুঁজে বলেছিলেন, “যা, মুড়ি কিনে আন।” স্কুলের পোশাকেই বেরিয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রীটি। বুধবার রাতভর খোঁজ মেলেনি পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার থানার রাজনগর গ্রামের ওই নাবালিকার।
বৃহস্পতিবার সকালে মেয়েটির দেহ মিলল গাছের ডালে, স্কুল ইউনিফর্মের বেল্টের ফাঁসে ঝুলন্ত অবস্থায়। অভিযোগ, গণধর্ষণের পরে খুন করা হয়েছে তাকে। আর সে কথা চাউর হতেই আইন হাতে তুলে নিল জনতা। সন্দেহের বশে শুরু হল গণপ্রহার। মারধরে প্রাণ গেল ওই নাবালিকার প্রতিবেশী প্রৌঢ় রতন দাসের (৫৫)-এর। তাঁরই আত্মীয় বাকি দুই অভিযুক্ত ভীম সিংহ ও ভজহরি দাস জখম অবস্থায় তমলুক হাসপাতালে ভর্তি। তাঁদের আটক করেছে পুলিশ। গ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
নাবালিকার বাবা রতনবাবু ও তাঁর দুই আত্মীয়ের নামে মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশেরও অনুমান, নির্যাতনের পরে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ওই নাবালিকাকে। জেলা পুলিশ সুপার সুকেশ কুমার জৈন বলেন, “তদন্ত শুরু হয়েছে।”
এ দিন ওই নাবালিকার ময়না-তদন্তের পরে তমলুক জেলা হাসপাতালে এসেছিলেন স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, “এমন মর্মান্তিক, নৃশংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, রাজনগর গ্রামের ওই ছাত্রীর বাবা পেশায় ভ্যানচালক। মা গৃহবধূ। তিন ভাইবোনের মধ্যে এই মেয়েটিই ছিল বড়। পাশের গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে পড়ত সে। বুধবার সন্ধ্যায় মুড়ি কিনতে গিয়ে ওই ছাত্রী দীর্ঘক্ষণ না ফেরায় তার মা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। জানানো হয় গ্রামবাসীকেও। প্রতিবেশীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে খোঁজ শুরু হয়। সেই সময় পড়শি রতনবাবু তাঁর বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেন বলে অভিযোগ। তখনই রতনবাবুর উপরে স্থানীয়দের সন্দেহ গিয়ে পড়ে।
জনরোষে বিধ্বস্ত অভিযুক্তের বাড়ি।
সেই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় এ দিন সকালে রতনবাবুর বাড়ির কাছে একটি নিমগাছের ডালে ওই নাবালিকার ঝুলন্ত দেহ দেখে। এর পরই জনতা রতনবাবুর বাড়িতে চড়াও হয়। রতনবাবু এবং তাঁর বাড়িতে থাকা ভীম সিংহ ও ভজহরি দাসকে রাস্তায় টেনে এনে বেধড়ক পেটানো হয়। বাড়িটিতে ভাঙচুর চালিয়ে, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তবে গ্রামবাসীদেরই একাংশের উদ্যোগে পরে গুরুতর জখম অবস্থায় ওই তিনজনকে তমলুক জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই মারা যান রতনবাবু। আহত দু’জন অবশ্য বৃহস্পতিবারেও কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না।
স্থানীয় সূত্রের খবর, রতনবাবু বাড়িতে একাই থাকতেন। বছর তিনেক আগে তাঁর স্ত্রী নিখোঁজ হয়ে যান। দিনভর নানা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা ওই প্রৌঢ় তন্ত্রসাধনা করতেন বলে এলাকাবাসী জানান। কিন্তু কেন এমন অভিযোগ উঠল ওই প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধে? মৃত নাবালিকার কাকার দাবি, জমিজমা নিয়ে কয়েক বছর আগে রতনবাবুর সঙ্গে তাঁদের পরিবারের বিরোধ হয়েছিল। তাঁদের অনুমান, সেই আক্রোশ থেকেই এই ঘটনা।
গ্রামে গিয়ে এ দিন দেখা গিয়েছে, রতন দাসের বাড়ি তখনও জ্বলছে। এলাকা ঘিরে রেখেছে পুলিশ। গ্রামবাসীর একাংশের দাবি, আধ কিলোমিটার দূরে বাজার লাগোয়া এলাকাতেই চোলাইয়ের ঠেকের রমরমা রয়েছে। রতনকে হামেশাই সেখানে দেখা যেত। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গ্রামবাসী বলেছেন, “চোলাইয়ের ঠেক ভাঙলেও অনেক উপকার হয়। পুলিশ সে সব দেখেও দেখে না!” পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, চোলাইয়ের বেআইনি ঠেক উচ্ছেদে মাঝেমধ্যেই অভিযান হয়। ধরাও হয় লোক জনকে।
বড় মেয়েকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ ছাত্রীটির বাবা। আর মা দুষছেন নিজেকে। শুধু বলছেন, “কেন যে ওকে মুড়ি কিনতে পাঠালাম!”
ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।