বাহারি: বিয়েবাড়িতে খাবারের কাউন্টার। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
কলাপাতার এককোণে নুন, লেবু। তারপর এল লম্বা করে ভাজা বেগুন আর লুচি। বিয়েবাড়ির আদ্যিকালের মেনু।
লোকে বলে, বাড়িতে বাঁশ ফেলা থেকে বিয়েবাড়ির শুরু হতো আগেকার দিনে। তারপর ভিয়েন বসানোর আয়োজন। কিন্তু সেসব দিন গিয়েছে।
খাবার পাত থেকে পরিবেশনের কেতা, গ্রামে-শহরে বিয়েবাড়ির ব্যবস্থাপনাটাই বদলে গিয়েছে। পাতে নানা প্রদেশের নানা পদের বাহার। কোনও কোনও সময়ে বাঙালি খাবার পাতে কোণঠাসা।
মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা সুমন্ত। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে রিয়ার বিয়ে হয়েছে। তাঁদের বিয়ের ভোজের পদ ছিল ভেজিটেবল চপ, ফ্রায়েড রাইস, চিকেন কষা, মটর পনির। পরে ভাত, মুগমোহন, মিক্সড ভেজ, খাসির মাংস। শেষ পাতে চাটনি, পাঁপড়, রসগোল্লা, কালাকাঁদ, আইসক্রিম। স্মিতা, সায়ন্তরও বিয়ে হয়েছে। ক’দিন আগে বিয়ে হয়েছে স্মিতা এবং সায়ন্তর। স্মিতার বৌভাতে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়েছিল প্রথম পাতে বাটার নান, চিকেন টিক্কা, বাটার মশালা, কাশ্মীরি আলুর দম দিয়ে। পরে বাসমতি রাইস, ডাল ফ্রাই, চিংড়ির মালাইকারি, খাসির মাংস। শেষপাতে এল চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি, আইসক্রিম।
বেশ কয়েক বছর থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রায় এইরকম পদই বিয়েবাড়িতে পাতে পড়ছে। এবং সেখানে বাঙালি পদ একেবারেই দু’চারটে। এ বিষয়ে সুমন্ত বলছিলেন, “মেনুর ব্যাপক পরিবর্তন নতুন কিছু খাওয়ানোর তাগিদেই।” এ বিষয়ে সুমন্তর সঙ্গে সহমত রিয়া। নববধূর কথায়, “বিয়ের ভোজের মেনু মানেই স্পেশাল কিছু। তবে পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতই।”
মেদিনীপুর শহরে বেশ কয়েকটি কেটারিং সংস্থা রয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শহরে বিয়েবাড়ির মেনুকার্ডগুলো মোটামুটি এরকম, শুরুতে চিকেন ললিপপ, ডালপুরী, ফ্রায়েড রাইস, চিলি পনির, চিংড়ির মালাইকারি। পরে ভাত, মাটন, ফ্রুট চাটনি, পাঁপড়, হট গোলাপজাম আর শেষে আইসক্রিম।
সাবেক: অনেকের ভরসা কলাপাতায় পঙক্তিভোজ। নিজস্ব চিত্র
কেটারিং সংস্থাগুলির মালিকদের বেশ কয়েকজন জানালেন, আজকাল স্টার্টারের চল বেড়েছে। অনেক জায়গাতেই পরিবেশন শুরু হয় ফাস্ট ফুড দিয়ে। তবে অন্য কথা শোনালেন শহরের কেটারিং সংস্থার মালিক প্রকাশ সাউ। তাঁর কথায়, ‘‘বিয়েবাড়িতে এখন অনেকে ভেজ পদও পছন্দ করছেন। একটা সময় অবাঙালি খাবার অনেকে খেতেই চাইতেন না। এখন সেই পরিস্থিতিও পাল্টেছে। বিয়েবাড়িতে অবাঙালি খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।” শহরের আরেক কেটারিং সংস্থার মালিক সুমনা আর্যের কথায়, “একটা সময় নান, রুমালি রুটি অনেকে মেনুতে রাখতেই দিতেন না। শুরুতে ফ্রায়েড রাইস রাখতে বলতেন। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। আজকাল মেনুর শুরুতে নান, রুমালি রুটি থাকছে। ফ্রায়েড রাইসের জায়গায় অনেকে বিরিয়ানি পছন্দ করছেন।’’
মেদিনীপুরের শহর এবং মফসসলে একটা সময়ে বিয়েবাড়িতে মুরগির মাংস একচেটিয়া ছিল। এখন আয়োজক এবং অতিথি উভয়েই পাতে মাটন পছন্দ করছেন বলে জানাচ্ছেন কেটারারেরা। প্রকাশ, সুমনারা মাটনের পাত জয়ের কথা স্বীকারও করছেন। তাঁদের দাবি, মেনুতে মাটন রাখার চেষ্টা করেন অনেকেই। অনেকে প্লেটের দর বাড়ছে দেখে একটা বা দু’টো আইটেম কমিয়ে দিয়ে মাটনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। অবশ্য অনেক সময় একটু বয়স্করা মাটন খেতে চান না। তাঁদের জন্য অন্য পদের ব্যবস্থা থাকে। শুরুর পাত আর মাঝের পাতের পরিবর্তনের সঙ্গে শেষ পাতেও বদল ঘটেছে। প্রকাশের কথায়, “শুরুতে স্টার্টারের চল বেড়েছে বলে শেষ পাতে মিষ্টি খাওয়ার আগ্রহ কমেছে।” তবে সেটা শুধু স্টার্টারের বাহুল্যে তা নয়। স্বাস্থ্যের কারণে অনেকে মিষ্টি নামমাত্র পাতে করেন।
তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে নতুন পদের সন্ধানের থেকে পুরনো দিনের খাবারে ফিরতে চাইছেন কেউ কেউ। এমনও জানাচ্ছেন কেটারারেরা। বিয়েবাড়ির কর্তারা তাঁদের পোলাও, ছানার ডালনার ব্যবস্থা করতে বলছেন। শহরের কয়েকটি বিয়েবাড়িতে কড়াইশুঁটির কচুরি, ছোলার ডাল, আলুর দমের দেখাও মিলছে। অনেক জায়গায় মাছের বিভিন্ন পদ রাখতে বলা হয় কেটারারদের।
স্বাভাবিক নিয়মেই মেনুর রকমফেরে নির্ভর করে খাবারের প্লেটের দাম। শহরের হিসেব বলছে, প্লেটের শুরু ২৫০-৩০০ টাকা। রাজকীয় আয়োজনে প্লেটের দাম ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এক ক্যাটারার জানালেন, ৩০০ টাকার প্লেট হলে অতিথিদের মন ভরবে। কিন্তু এর কমে প্লেট হলে অতিথিরা বলতেই পারেন, ‘আয়োজন সামান্য।’ গ্রামে প্লেটের শুরু ২০০ টাকা থেকে। মেনুতে পরিবর্তন হয়েছে গ্রামাঞ্চলেও।
আনন্দপুরের ধারাশোলে সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে সঙ্ঘমিত্রার। তাঁর বিয়ের ভোজে অন্য পদের সঙ্গে ছিল চিলি চিকেন, ভেজ পনির। বছর কয়েক আগেও চিলি চিকেন, ভেজ পনিরের কোনও অস্তিত্ব ছিল না বিয়েবাড়িতে। চন্দ্রকোনার কেটারিং সংস্থার মালিক গৌতম ঘোষের কথায়, ‘‘নতুন পদ ঢুকতে শুরু করেছে গ্রামাঞ্চলেও।’’
শুধু মেনুতে নয়। বিয়েবাড়ির আয়োজনেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই। বিয়ের অনুষ্ঠান তো আর একদিনে শেষ হয় না। অন্তত তিন দিন অতিথিদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হয়। ফলে দুপুরের খাওয়া নিয়েও ভাবতে হয়। তার আয়োজন যথেষ্ট ঝক্কির। লাগে লোকবলও। তাই এই ভার নিজেদের উপরে রাখতে চান না অনেকে। ফলে শুধু মেদিনীপুর শহর নয়, গ্রামেগঞ্জেও এখন বাড়িতে রান্নার আয়োজন কমছে। বাড়ছে অনুষ্ঠান বাড়ির ওপরে নির্ভরতা। খাবার ব্যবস্থা, বিয়েবাড়ি সাজানো সব কিছুর জন্যই আলাদা আলাদা সংস্থা মেলে এখন। তাদের উপরে পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দিলে আর চিন্তা নেই। এই কারণে দিনে দিনে কেটারিং সংস্থার সংখ্যা বাড়ছে বেলদা, খড়্গপুর, গড়বেতা-সহ বিভিন্ন এলাকায়।
এর কারণ বলছিলেন অমর জানা। তাঁর কথায়, ‘‘যদি বাড়িতে বিয়ের আয়োজন করা হয় তাহলে সবসময় তদারকির চাপ থেকেই যায়। রান্না কতদূর এগোল, মালপত্র কিছু কম পড়লে আবার বাজারে ছোটা। মিষ্টি আনার জন্য একজনকে ভার দিতে হয়। এই মাথাব্যথাটা একদমই থাকে না কেটারারদের দায়িত্ব দিলে। সময় বাঁচে।’’ এরপর আছে পরিবেশনের ঝামেলা। শহরের বাসিন্দা শিবশঙ্কর জানা, সমর সামন্তদের আত্মীয়স্বজনেরা গ্রামে থাকেন। গ্রামে অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়াবাড়ি নেই। আছে দেড় কিলোমিটার দূরে। এখন সেই বাড়িই ভাড়া নিতে শুরু করেছেন তাঁরা।
চাহিদা মেনে কেটারিং সংস্থাগুলোও নিজেদের বদলাচ্ছে। নির্দিষ্ট পোশাক তো ছিলই। এখন হাতে দস্তানা, মাথা ঢাকা দেওয়া ক্যাটারিং কর্মীরা বিয়েবাড়িতে পরিবেশন করছেন। এমন দৃশ্য বাড়ছে। গ্রামেও।