পুরবোর্ড গঠন নিয়ে হাজারও প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রেলশহরের আনাচে-কানাচে। সমীকরণ হচ্ছে নানা। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও একটা বিষয়ে শহরবাসী বেশ খুশি। ৩৫ আসনের খড়্গপুরে এ বার ১৭ আসনেই জয়ী হয়েছেন মহিলা প্রার্থীরা। তার মধ্যে বাম, বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল— সব দলের প্রার্থীরাই আছেন। সবচেয়ে বড় কথা যেখানে আসন সংরক্ষণ করে মহিলা প্রার্থীদের লড়াইয়ে জায়গা দেওয়া হয়, সেখানে অসংরক্ষিত আসনে পুরুষ প্রার্থীর সঙ্গে লড়েও জয়ী হয়েছেন মহিলা প্রার্থীরা।
জয়ী মহিলা কাউন্সিলরদের প্রতি আস্থাও রাখছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষত পানীয় জল, নিকাশির মতো প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন দেখছেন খড়্গপুরের মহিলারা। পাশাপাশি পুরসভায় জোরালো হচ্ছে আশা, পুরসভায় নারী সুরক্ষার দিকটি আরও বেশি করে গুরুত্ব পাবে।
মহিলাদের অধিকার রক্ষায় এ বছর নির্বাচন কমিশনের তরফে ন’টি আসন বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সেই অনুযায়ী ২, ৫, ৮, ১২, ১৯, ২৩, ২৬, ৩০, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা সংরক্ষিত ছিল। এ ছাড়াও ১৫ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড ছিল তফশিলি জাতির মহিলাদের দ্বারা সংরক্ষিত। অর্থাৎ সেই ৩১ শতাংশ সংরক্ষণ। কিন্তু অন্য সমীকরণের হিসাব মিলতে শুরু করল ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর থেকেই। শেষ পর্যন্ত প্রায় ৪৯ শতাংশ আসন দখল করে ফেললেন মহিলা প্রার্থীরা। সংরক্ষিত আসন ছাড়াও ৭, ৯, ১৪, ১৬, ১৮, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের মতো সাধারণ আসনেও জয়ী হয়েছেন মহিলারা।
তবে খড়্গপুরে এই ‘ট্রেন্ড’ নতুন নয়। ২০১০ সালের প্রায় ৩৪ শতাংশ আসন দখল করেছিলেন মহিলা প্রতিনিধিরা। ২০০৫ সালে কিন্তু ৩০টি আসন বিশিষ্ট পুরবোর্ডে ছিলেন মাত্র ৬ জন মহিলা। খড়্গপুরের ইতিহাসে এ বারই সর্বাধিক মহিলা প্রতিনিধি থাকবেন। অসংরক্ষিত আসন থেকে জয়ী হয়েছেন ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী কল্যাণী ঘোষ। ২০০৫ সাল থেকে ওই ওয়ার্ডেই টানা কাউন্সিলর ছিলেন কল্যানীদেবী। জয়ের কারণ হিসাবেও তিনি এই দীর্ঘদিনের কাজকেই মূল ধাপ বলে বর্ণনা করেছেন, “আমার জয়ে নারীশক্তির একটা বড় অবদান রয়েছে বলেই মনে করি। বিগত ১০ বছরে আমি মহিলা হয়েও একজন পুরুষ কাউন্সিলরের তুলনায় বেশি কাজ করেছি। এ বারের জয়ের কারণ সেই কাজ।’’
অন্য দিকে, ২০০৫ সাল থেকে একটানা জয়ী হচ্ছেন বিজেপি-র বেলারানি অধিকারীও। তিনি বলেন, “এখানে জল, নিকাশি, বিধবা ভাতা-সহ নানা পরিষেবায় প্রতিদিন মহিলাদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। এ বার চেষ্টা করব যাতে সব মহিলা কাউন্সিলরা একসঙ্গে থেকে মহিলাদের সমস্যা সমাধান করতে পারি।’’
এ বারের নির্বাচনে বদলেছে ভোটের সমীকরণও। গত বারে পুরবোর্ডে ১২ জন মহিলা প্রতিনিধির মধ্যে পাঁচ জনই ছিলেন তৃণমূলের। কংগ্রেসের চার, বামেদের দুই ও বিজেপি-র মাত্র একজন মহিলা কাউন্সিলর ছিলেন। কিন্তু এ বছর বিজেপি সবাইকে টপকে গিয়েছে হিসাবের দিকে। তাদের জয়ী সাতটি আসনের ছ’টি আসনই দখল করেছেন মহিলা প্রার্থীরা। অন্যদিকে তৃণমূলের চার, বামেদের চার ও কংগ্রেসের তিন জন মহিলা প্রতিনিধি রয়েছেন এ বারের পুরবোর্ডে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক আসনে মহিলাদের আধিপত্য দেখা যাবে পুরবোর্ডে।
এ দিকে এখনও পুরবোর্ড গঠন নিয়ে জল্পনার অবসান হয়নি। এ বারে তৃণমূল ও কংগ্রেস উভয়েই ১১টি করে আসন পেয়েছে। বামেদের হাতে ছয় ও বিজেপি-র দখলে সাতটি আসন রয়েছে। তাই বাম অথবা বিজেপি-র মধ্যেই কারও সমর্থন নিয়ে জোটবদ্ধ পুরবোর্ড গঠন হবে বলে ধারণা রাজনৈতিক মহলের। ফলে শুরু হয়ে গিয়েছে নানা রাজনৈতিক খেলা। সম্প্রতি বিজেপি-র টিকিটে জয়ী পূজা নায়ডুর সমর্থন পেতে মেদিনীপুর জেলে গিয়ে রেলমাফিয়া শ্রীনু নায়ডুর সঙ্গে তৃণমূলের প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা এ বারও জয়ী জহরলাল পাল দেখা করেছেন বলে জানা গিয়েছে। তবে এখনও পুরবোর্ড গঠনে কোনও রাজনৈতিক দলই অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি।
তবে শহরবাসীর চাইছেন, রাজনীতি ছেড়ে অন্তত মহিলা প্রতিনিধিরা যেন জোটবদ্ধ হয়েই শহরের স্বার্থে উন্নয়নের কাজ করেন। ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সরকারি কর্মী সোমা সেনগুপ্তর কথায়, “আশা করি পুরবোর্ডে প্রায় অর্ধেক প্রতিনিধি যদি মহিলা হন তবে নিশ্চয়ই তাঁরা রাজনীতির বাইরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের কথা ভাববেন বলে। মহিলাদের নিরাপত্তা জোর দেওয়ার দাবি জানাব।”