বহুতলে ঝুঁকছে তমলুক, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য তিমিরেই

তাম্রলিপ্ত থেকে তমলুক, তারপর সরকারি ভাবে ফের ‘তাম্রলিপ্ত’। প্রাচীন-আধুনিকতার মিশেলে প্রাণবন্ত পূর্ব মেদিনীপুরের বর্ধিষ্ণু এই জনপদ। রাজ্যের আর পাঁচটা শহরের স্বাভাবিক প্রবণতার মতো অধুনা জেলা সদর তমলুকেও প্রশাসনিক কেন্দ্র থেকে হাসপাতাল, নানাবিধ সুযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় শহর যেমন আড়ে-বহড়ে বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে চড়ছে জমির দাম।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৩৬
Share:

বাড়ছে শহরের পরিধি। দক্ষিণচড়ায় উঠছে বহুতল (বাঁ দিকে), শঙ্করআড়া এলাকায় নতুন আবাসন (ডান দিকে) পার্থপ্রতিম দাসের তোলা ছবি।

তাম্রলিপ্ত থেকে তমলুক, তারপর সরকারি ভাবে ফের ‘তাম্রলিপ্ত’। প্রাচীন-আধুনিকতার মিশেলে প্রাণবন্ত পূর্ব মেদিনীপুরের বর্ধিষ্ণু এই জনপদ। রাজ্যের আর পাঁচটা শহরের স্বাভাবিক প্রবণতার মতো অধুনা জেলা সদর তমলুকেও প্রশাসনিক কেন্দ্র থেকে হাসপাতাল, নানাবিধ সুযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় শহর যেমন আড়ে-বহড়ে বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে চড়ছে জমির দাম।

Advertisement

২০০২ সালের পয়লা জানুয়ারি নবগঠিত পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা শহর হিসেবে স্বীকৃতির পর শহরের প্রশাসনিক গুরুত্ব এক ধাক্কায় বেড়েছে। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ছোট্ট মহকুমা শহর থেকে জেলা শহরে উত্তীর্ণ এই শহরের পানীয় জল কিংবা নিকাশি সমস্যার তেমন উন্নতি না-হলেও নগরায়নের পথে এগোচ্ছে এই শহর। তারই দৌলতে মাত্র ১২ বছরের মধ্যে শহর সংলগ্ন জমির দাম এক লাফে বেড়েছে অন্তত ১২ গুণ।

শহরের ধারিন্দার বাসিন্দা রণজিৎ ঘাটা বলেন, “পাঁচ বছর আগেও এলাকায় ডেসিমল প্রতি জমির দাম ছিল ৪০ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে দেড় থেকে দু’লক্ষ টাকা।” চাকুরি কিংবা ব্যবসা সূত্রে গ্রাম থেকে শহরে এসে তিন-চার-পাঁচ ডেসিমল জমি কিনে নিজস্ব বাড়ি তৈরির ঝোঁক বাড়ছে। এর ফলে শহরের পুরনো এলাকায় ঠাঁই না পেয়ে পার্শ্ববর্তী ধারিন্দা, চককামিনা, সোনামুই, শ্রীকৃষ্ণপুর, নিমতৌড়ি, কুলবেড়িয়া, গণপতিনগর, রাধাবাল্লভপুর, নকিবসান, কাপাসবেড়িয়া এলাকায় জমি কেনার হিড়িক শুরু হয়েছে। তাতেই চড়ছে জমির দাম।

Advertisement

‘রূপনারায়ণের কূলে’ গড়ে ওঠা একদা তাম্রলিপ্ত বন্দরের চিহ্নও নেই অধুনা তমলুকে। নেই স্টিমার ঘাটের কাছে যাত্রীবাহী স্টিমারের আনাগোনা। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন বন্দর নগরী তাম্রলিপ্তই আজকের তমলুক কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে প্রাচীনতা, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিচারে তমলুকের গুরুত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। পুর-ভবনের সামনের একটি ফলকের তথ্য থেকে জানা যায়, তমলুকে নগরায়নের শুরু ইংরেজদের হাত ধরে। সময়টা অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। সে সময়ে তমলুকে বড় বড় নুন রাখার গুদাম তৈরি হয় (নিমকমহল)। বহু ব্রিটিশ রাজ কর্মচারী এবং বহু শিক্ষিত লোকের সমাগম হতে থাকে তমলুকে। ক্রমেই গড়ে ওঠে মুন্সেফি আদালত (১৮৩২)। মহকুমার পথ চলা শুরু ১৮৫২। এর বারো বছর পর ১৮৬৪ সালের ১লা এপ্রিল পুরসভা গঠিত হয়। প্রাচীন তাম্রলিপ্ত নাম থেকে অধনা তমলুক প্রাচীনকে আগলে এগোনোর প্রয়াস।

রাজ্যের প্রাচীন পুরসভারগুলির অন্যতম তমলুক। দেড়শো পেরেনো এই পুর-শহরের আয়তন বাড়ছে প্রতিদিন। কৃষি প্রধান এলাকা থেকে শহরে আসা মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের কাছে অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়স্থল তমলুক। ফলে এক জেলা শহর ঝুঁকছে আবাসনেও। শহরের পার্বতীপুর, মানিকতলা এলাকায় একাধিক বহুতল হয়েছে। শালগেছিয়া, পদুমবসান, ধারিন্দা, তমলুক রেলস্টেশন এলাকায় তৈরি হচ্ছে আরও একাধিক বহুতল। এক কথায়, চেহারা পাল্টাচ্ছে ওই এলাকার। পাশাপাশি পুরনো দিনের স্মৃতি উসকে এখনও শহরের বুকে দাঁড়িয়ে প্রাচীন কিছু বাড়ি। যেমন শহরের প্রাণকেন্দ্র পার্বতীপুর, টাউন শঙ্কআড়া, আবাসবাড়ি এলাকা।

শহরের অদূরে পশ্চিম দিকে হলদিয়া-মেচেদা ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে নিমতৌড়িতে জেলা সদরের মূল প্রশাসনিক ভবন তৈরি শুরু হয়েছে। সেখানেও বাড়ছে জমির চাহিদা। শহরের পুব দিকে রূপনারায়ণের তীরবর্তী চর এলাকাতেও হচ্ছে বাড়ি। আইন-শৃঙ্খলার দিক থেকে নিরাপদ হওয়ায় এই শহর মধ্যবিত্তের বিশেষ পছন্দ।

পর্যাপ্ত পরিকাঠামো তৈরির জন্য শহরের আয়তন বাড়ানোর ভাবনা রয়েছে পুরসভার। তমলুক লাগোয়া আরও ২০টি গ্রামীণ মৌজাকে পুরসভার সঙ্গে জুড়ে শহর সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তা বাস্তবায়িত হলে এক ধাক্কায় শহরের জনসংখ্যা এক লাখ ছাড়াবে (বর্তমান জনসংখ্যা ৬০ হাজার) বলে আশা পুরসভার। পুরপ্রধান দেবিকা মাইতি বলেন, “জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেই আয়তন বাড়ানোর পরিকল্পনা। এ জন্য প্রশাসনিক কাজ অনেকটাই এগিয়েছে।”

জেলা শহরের আয়তন, জনসংখ্যা বাড়ছে। জমি-বাড়ির চাহিদাও ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু নাগরিক স্বাছন্দ্য কী উন্নত হচ্ছে? পুরপ্রধান জানান, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রেখে পুর-উদ্যোগে শহর সংলগ্ন এলাকায় তিনটি জলাধার তৈরি হয়েছে। নদী থেকে জল তুলে পরিস্রুত করে সরবরাহের জন্যও প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। শহরের পুরানো রাস্তাগুলির যতটা সম্ভব সম্প্রসারণ করার কাজ চলছে।

শহরের এক বাসিন্দার অবশ্য অভিযোগ, কলকাতা থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে এই জেলা শহরের আধুনিক চেহারা বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই নেই বললে চলে। নেই পরিকল্পিত চওড়া রাস্তা, নিকাশি। শহরের এক প্রান্ত থেকে দ্রুত অন্য প্রান্তে যাতায়াতের মত যানবাহনও কম। ফলে জেলা শহর হলেও নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য থেকে অনেকটাই পিছিয়ে তমলুক। এই শহরের মাঝ-বরাবর চলে গিয়েছে হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়ক। এ ছাড়াও রয়েছে পাঁশকুড়া-তমলুক-হলদিয়া, তমলুক-শ্রীরামপুর সহ একাধিক পাকা রাস্তা। শহরবাসীর আক্ষেপ, রাস্তাগুলি বহু দিন সংস্কার হয়নি। শহরের পাশে রূপনারায়ণ নদীর সঙ্গে একাধিক নিকাশি খালের যোগ থাকলেও নিকাশিরও তেমন উন্নতি হয়নি।

তবে, আশার কথা বছর দেড়েক আগে জেলা শহর-সহ তমলুকের গ্রামীণ এলাকা হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের আওতায় এসেছে। এর ফলে তমলুক শহরের পরিকাঠামো নির্মাণে সুবিধা হবে বলে আশা শহরবাসীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন