নালিশ প্রশাসনিক উদাসীনতার

বিস্মৃতির দিন গুনছে নীল তৈরির আঁতুড়ঘর

বাইরে থেকে দেখলে প্রথমে ঠাহর হয় না। ঝোপঝাড় ঠেলে একটু এগোলে সামনে আসে শ্যাওলা পড়া বিশাল স্থাপত্যটা। কে বলবে, এক সময় এই বিশাল বাড়িতেই আদিবাসী-মূলবাসী শ্রমিকদের দিয়ে নীল তৈরি করাতেন নীলকর সাহেবরা!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বেলপাহাড়ি শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৭ ০১:৩৫
Share:

অবহেলিত: এভাবেই ভেঙে পড়ে রয়েছে বেলপাহাড়ির দেড়শো বছরেরও পুরনো নীলকুঠি। নিজস্ব চিত্র

বাইরে থেকে দেখলে প্রথমে ঠাহর হয় না। ঝোপঝাড় ঠেলে একটু এগোলে সামনে আসে শ্যাওলা পড়া বিশাল স্থাপত্যটা। কে বলবে, এক সময় এই বিশাল বাড়িতেই আদিবাসী-মূলবাসী শ্রমিকদের দিয়ে নীল তৈরি করাতেন নীলকর সাহেবরা! কে বলবে, বেলপাহাড়ির এই নীলকুঠির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নীল বিদ্রোহের সময়কার এক ব্যতিক্রমী ইতিহাস!

Advertisement

নীল তৈরির চিমনি-সহ প্রস্তুতিকরণ ঘরটিও ভগ্নপ্রায়। সেখানে শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে অশ্বত্থ গাছ। স্থাপত্যের পাশে গা ঘেঁষে তৈরি হয়ে গিয়েছে একটি মন্দির। দেড়শো বছরের পুরনো নীলকুঠি সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনিকস্তরে আজ পর্যন্ত উদ্যোগই হয়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

সময়টা ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি। ভূমি দফতরের পুরনো নথি থেকে জানা যায়, বেলপাহাড়ি, ভেলাইডিহা, সন্দাপাড়া, ভুলাভেদা, শিমুলপাল ও বাঁশপাহাড়ির প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে এক সময় নীল চাষ হত। বাংলা জুড়ে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চাষিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুরের উত্তরাঞ্চল, বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, পাবনা ও খুলনায় একের পর এক নীলকুঠি ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারিতে আগুন জ্বলছে। অথচ সেই বিদ্রোহের আঁচ এসে পড়েনি পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা বেলপাহাড়ির শান্ত জনপদে।

Advertisement

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বেলপাহাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা তখন দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঘেরা। স্থানীয় বাসা পাড়ায় নীলকুঠিতে রীতিমতো নীল তৈরির ভাটিখানা চলত। ওই সময় বেলপাহাড়ির নীল চাষিরা বিদ্রোহের পথে যাননি। কোনও প্রতিবাদের কথাও শোনা যায় না। কেন এমন ব্যতিক্রমী বৈচিত্র্য?

মেদিনীপুরের প্রবীণ পুরাতত্ত্ব গবেষক চিন্ময় দাশ জানান, ওই সময় বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত এলাকাগুলি ছিল রীতিমতো দুর্গম ও শ্বাপদসঙ্কুল। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। অভাব ছিল বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। জঙ্গল থেকে সহজেই মিলত হেঁসেলের জ্বালানি কাঠ। এলাকায় কৃষকদের সংগঠনও প্রায় ছিল না। সম্ভবত, এই জন্যই নীলকরদের চাপের মুখে নীলচাষ করেও বেলপাহাড়ির দরিদ্র বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় কোনও প্রভাব পড়েনি। কোনও বিদ্রোহও তাই দানা বাঁধেনি।” গবেষকদের দাবি, এলাকাবাসীর কোনও
প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না থাকায় বেলপাহাড়ির নীলকুঠিতে কোনও কয়েদখানাও ছিল না।

১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে মীরজাফর দ্বিতীয়বার বাংলার নবার হওয়ার পরে শিলদা পরগনার অন্তর্গত বেলপাহাড়ির বিস্তীর্ণ অংশ চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানি’র অধীনে। বেলপাহাড়ির বিশাল এলাকা জুড়ে কাছারি বাড়ি তৈরি হয়। পরে সেখানে ইংরেজ জমিদারের জন্য বাংলোও তৈরি হয়। তার আগেই অবশ্য বেলপাহাড়িতে নীল চাষ শুরু হয়। ইংরেজ জমিদারি কোম্পানির তরফে লেঠেল নিয়োগ করে গ্রামে গ্রামে চাষিদের দাদন দিয়ে নীলের চাষ করানো হত। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়।

জমিদারি কোম্পানির পূর্বতন কাছারি বাড়িটি এখন বেলপাহাড়ি ব্লক অফিস। সাহেব বাংলোটিতে বিডিও-র আবাসন। বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে সংস্কার হওয়ায় দু’টি সরকারি ভবনই এখন একেবারে ঝাঁ-চকচকে!

আর বেলপাহাড়ির এক প্রান্তে বিলুপ্তি ও বিস্মৃতির অপেক্ষায় দিন গুনছে আদিবাসী-মূলবাসীদের রক্তঘামে নীল তৈরির আঁতুড় ঘর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন