মেদিনীপুরে কালেক্টরেট মোড়ে সিপিএমের মিছিলে হামলা তৃণমূলের।
ধর্মঘট প্রতিহত করতে রাস্তায় নামল তৃণমূলের বাহিনী। লাঠি হাতে হামলা চালানো হল ধর্মঘটীদের মিছিলে। পুলিশের সামনেই মার খেলেন সিপিএম এবং বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা। বৃহস্পতিবার বিরোধীদের ডাকা ধর্মঘটের দিন এমনই দৃশ্য দেখল মেদিনীপুর শহর।
এ দিন দু’দফায় হামলা চালায় তৃণমূলের বাহিনী। প্রথমে কালেক্টরেট মোড়ে সিপিএমের মিছিলে। পরে রবীন্দ্রনগরে বিজেপির মিছিলে। ধর্মঘটীদের বেধড়ক মারধর করা হয়। অভিযোগ, বিনা প্ররোচনায় পুলিশের সামনেই তাণ্ডব চালায় শাসক দলের লেঠেল বাহিনী। তবু পুলিশ হামলাকারীদের বিরত করেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোটা ঘটনা দেখেছে। বিজেপির পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায় বলেন, “ধর্মঘট প্রতিহত করতে পুলিশ-তৃণমূল যৌথ ভাবে রাস্তায় নামল। দলের কর্মী-সমর্থকদের বেধড়ক মারধর করা হল। মেদিনীপুরে আগে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি।’’ সিপিএমের শহর জোনাল সম্পাদক সারদা চক্রবর্তীরও অভিযোগ, “ধর্মঘট প্রতিরোধ করার নামে তৃণমূল রাস্তায় নেমে গুণ্ডামি করল। পুলিশের সামনেই মিছিলে হামলা হল। অথচ, পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল।”
কেন পুলিশ হামলাকারীদের ধরেনি? জেলা পুলিশের কোনও জবাব মেলেনি। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষের ফোন বেজে গিয়েছে। এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেননি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) অংশুমান সাহাও।
হামলার অভিযোগ অবশ্য মানছেন না। তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের দাবি, “আমরা সিপিএমের মতো প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না! আর এ দিন কাউকে মারধর করা হয়েছে কি না জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখছি!”
শাসক দলের জেলা সভাপতি প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না বলে দাবি করলেও এ দিন সকাল থেকে মেদিনীপুর শহরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে তৃণমূলের ক্যাডার বাহিনী। বেলা যত গড়িয়েছে, উত্তেজনা তত বেড়েছে। সকালে শহরে বন্ধের সমর্থনে মিছিল করে সিপিএম। কালেক্টরেট মোড়ের সামনে ওই মিছিলের উপর হামলা করে তৃণমূলের বাহিনী। শহরের এই এলাকায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল। অবশ্য হামলাকারীদের বিরত করতে পুলিশ কোনও পদক্ষেপই করেনি বলে অভিযোগ। তৃণমূলীদের হামলায় জখম হন অবধেশ সিংহ, শ্যামল দাস, মৃণাল পাল-সহ অন্তত ৭ জন সিপিএম কর্মী- সমর্থক। সিপিএমের শহর জোনাল সম্পাদক সারদা চক্রবর্তী বলেন, “পুলিশের সামনেই মিছিলে হামলা হল। অথচ, পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল।” তাঁর কথায়, “ধর্মঘট প্রতিরোধ করার নামে তৃণমূল রাস্তায় নেমে গুণ্ডামি করল।” অন্যদিকে, শহরে বন্ধের সমর্থনে মিছিল করে বিজেপিও। ওই মিছিল যখন রবীন্দ্রনগরে ফেডারেশন হলের সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তৃণমূলীরা হামলা করে। জখম হন বিজেপির শহর সহ- সভাপতি রঞ্জিত সিংহ সহ অন্তত ৬ জন। বিজেপির শহর সভাপতি অরূপ দাস বলেন, “এদিন বন্ধ রুখতে দুই অস্ত্রই সক্রিয় ছিল। একটা পুলিশের বৈধ অস্ত্র। আরেকটা তৃণমূল বাহিনীর অবৈধ অস্ত্র!” তাঁর কথায়, “ধর্মঘট ব্যর্থ করতে সরকার যেখানে পুলিশকে মাইক হাতে পথে নামায়, সেখানে রাজ্যের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা সহজেই বোঝা যায়!”
ধর্মঘট রুখতে শাসক যে একরোখা, তার ইঙ্গিত মিলেছিল বুধবারই। পুলিশ- প্রশাসন ও দলের কর্মীদের নিয়েই যে তৃণমূল সরকার বন্ধ প্রতিরোধের পথে যাবে, তা বোঝা গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার মেদিনীপুরে বন্ধের মিশ্র সাড়া পড়ে। স্কুল- কলেজ, সরকারি অফিস খোলা ছিল। তবে হাজিরা ছিল অনান্য দিনের থেকে কম। খুব কম সংখ্যক বেসরকারি বাস পথে নেমেছে। বেশির ভাগ দোকানপাট অবশ্য বন্ধ ছিল। সকালের দিকে মিছিল করে গিয়ে বেশ কয়েকটি দোকান জোর করে খোলা করিয়েছে তৃণমূলের বাহিনী। তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেনবাবু অবশ্য বলছেন, “কোথাও জোর করে বন্ধ- রোধ করা হয়নি। এটা কর্মনাশা বন্ধ। মানুষ বন্ধ- ধর্মঘট চান না। তাঁরা চান, জনজীবন সচল থাকুক।” তাঁর কথায়, “বৃহস্পতিবার এমনিতেই মেদিনীপুর শহরের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ থাকে। এদিনও তাই ছিল।” ধর্মঘটের সমর্থনে যখন মেদিনীপুরে মিছিল করছে সিপিএম, বিজেপি। তখন শহরে মিছিল করেছে তৃণমূলও। দীনেনবাবুর পাশাপাশি মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রদ্যোত্ ঘোষ, আশিস চক্রবর্তী, শৈবাল গিরির মতো শাসক দলের জেলা নেতৃত্ব। জেলা পরিষদ খোলা ছিল। এসেছিলেন সভাধিপতি উত্তরা সিংহ সহ অনান্য কর্মাধ্যক্ষরা। মেদিনীপুর-খড়্গপুর উন্নয়ন পর্ষদ (এমকেডিএ) খোলা ছিল। এসেছিলেন এমকেডিএর চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতি-সহ আধিকারিক-কর্মচারীরা। পুরসভাও খোলা ছিল। দিনের শেষে সিপিএমের এক জেলা নেতা অবশ্য বলছেম, “ধর্মঘট প্রতিহত করতে যে ভাবে তৃণমূল তাদের ক্যাডার বাহিনীকে ময়দানে নামাল, তা থেকেই স্পষ্ট ধর্মঘট কতটা সফল!”
রেলশহর খড়্গপুরেও এ দিন বিক্ষিপ্ত গোলমাল ছড়ায়। বৃহস্পতিবার শহরের অধিকাংশ দোকানপাট ছিল বন্ধ। টেলিফোন, কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বেসরকারি অফিসও বন্ধ ছিল। তবে অন্য দিনের মতো রেলের ডিভিশনাল কার্যালয়, ডাকঘরে স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার হওয়ায় নিয়মমাফিক বন্ধ ছিল গোলবাজারে সব দোকানপাট। এ দিন সকালে শহরের পুরীগেটের কাছে রেললাইনের উপর বসে যায় সিপিএমের কর্মীরা। ওই কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন সিপিএমের শহর জোনাল সদস্য অনিল দাস, জেলা কমিটির সদস্য মনোজ ধর প্রমুখ। ওই রেল অবরোধের জেরে পুরীগেটে সকাল ৮টা নাগাদ আটকে পড়ে পটনাগামী এন্নাকুলাম এক্সপ্রেস ও একটি মালগাড়ি। এরপর রেল পুলিশ এসে অবরোধ তুলে দেয়।
বন্ধের সমর্থনে এ দিন খড়্গপুরের বড়বাতি থেকে বামেদের মোটর বাইক র্যালি বেরিয়ে গোলবাজার, বাসস্ট্যান্ড, ঝাপেটাপুর, নিমপুরা-সহ শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফের বড়বাতির কাছেই শেষ হয়। খরিদায় তৃণমূলের শহর কার্যালয়ে কাছে একটি দোকান বন্ধের আবেদন জানায় র্যালিতে সামিল হওয়া দুই সিপিএম দুই কর্মী। তৃণমূল কার্যালয় থেকে শহর তৃণমূল সভাপতি দেবাশিস চৌধুরী বেরিয়ে এলে গোলমাল বেধে যায়। ওই দুই সিপিএম কর্মীর বাইক আটকে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। সিপিএমের শহর জোনাল সম্পাদক অনিতবরণ মণ্ডল বলেন, ‘‘আমাদের র্যালির পিছনে থাকা দুই যুবক দোকান বন্ধের আবেদন জানালে তৃণমূলের শহর সভাপতি তাঁদের মারধর করেন। আমরা বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছি।’’ ‘ধর্মঘট রুখতে অতি সক্রিয় পুলিশ’ আইআইটি-র সামনে একটি ব্যাঙ্কের সামনে জড়ো হওয়া ৫ সিপিএম কর্মীকে গ্রেফতার করেছে বলেও জানান তিনি।
যদিও মারধরের কথা অস্বীকার করেছেন দেবাশিসবাবু। তিনি বলেন, “ওরা কার্যালয়ের সামনে এসে গালমন্দ করছিল। জোর করে দোকান বন্ধ করে দিচ্ছিল। তাই বাধা দিয়েছি। তাতেই ওরা পালিয়ে গিয়েছে।’’
বৃহস্পতিবার ছবিগুলি তুলেছেন সৌমেশ্বর মণ্ডল ও রামপ্রসাদ সাউ।