গ্রামেও কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ

পুরসভা পারেনি, পঞ্চায়েত কি পারবে!

পুরসভাগুলি এখনও পারেনি। তারই মধ্যে এ বার পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতে চালু হতে চলেছে কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ (সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট) প্রকল্প।

Advertisement

সুমন ঘোষ

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৬ ০১:২৪
Share:

মেদিনীপুর শহরের মিঞাবাজারে রাস্তার ধারে স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে আবর্জনা।

পুরসভাগুলি এখনও পারেনি। তারই মধ্যে এ বার পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতে চালু হতে চলেছে কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ (সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট) প্রকল্প।

Advertisement

জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশিরভাগ পঞ্চায়েতই পিছিয়ে পড়া এলাকার মধ্যে পড়ে। যেখানে মেদিনীপুর-খড়্গপুরের মতো শহরে এখনও এই ব্যবস্থা কার্যকর করা যায়নি, সেখানে সব পঞ্চায়েতে কী ভাবে তা চালু হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যদিও জেলা প্রশাসনের বক্তব্য, আগামী আর্থিক বছরের মধ্যেই পরিকাঠামো নির্মাণ করে প্রকল্প চালুর সব ধরনের চেষ্টা হবে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ বলেন, ‘‘গ্রামে বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা থাকে না। এই প্রকল্প চালু হলে সেই সব বর্জ্য তুলে নিয়ে আসারও ব্যবস্থা করা হবে। তা দিয়ে সারও তৈরি করা হবে।’’ প্রাথমিকভাবে জেলার ২৯০টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৩০টিতে এই প্রকল্প রূপায়ণে উদ্যোগী হয়েছিল প্রশাসন। ২৮টি পঞ্চায়েত তার জন্য প্রস্তাব পাঠায়। তার মধ্যে ১৭টিতে প্রকল্পের জন্য জমি মিলেছে। ১৫টির জন্য প্রকল্প পিছু ১৫ লক্ষ করে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজও শুরু হয়েছে কয়েকটি জায়গায়।

সদ্য সমাপ্ত বাজেটেও স্বচ্ছ ভারত অভিযানে বিপুল বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। রাজ্যে এর নাম মিশন নির্মল বাংলা। ওই প্রকল্পেই ‘সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর উল্লেখ রয়েছে। স্বচ্ছ ভারত অভিযানেই প্রকল্প পিছু ২০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু ওই টাকায় প্রকল্পের সম্পূর্ণ রূপায়ণ সম্ভব নয়। তাই জমি সমতলীকরণ-সহ বিভিন্ন কাজে একশো দিনের প্রকল্পকে যুক্ত করা, পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিল থেকেও অর্থ নেওয়া হবে। প্রশাসন জানিয়েছে, যে সব পঞ্চায়েত প্রাতিষ্ঠানিক স্ব-শক্তিকরণের আওতায় রয়েছে সেগুলিতে আগে এই প্রকল্প হবে। জেলায় এমন পঞ্চায়েতের সংখ্যা ১৭২টি।

Advertisement

প্রায় প্রতিটি বাড়িতে রান্নার পরে আবর্জনা আশপাশে ফেলা হয়। হাট-বাজারের জঞ্জালও পাশেই ডাঁই করে ফেলে রাখা হয়। তা পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। পরিবেশ দূষিত হয়। এই সব বর্জ্য কোথায় ফেলা হবে? তার জন্যই এই প্রকল্প তৈরির ভাবনা। এর লক্ষ্য হল— পচনশীল ও পচনশীল নয়, এই নিরিখে দৈনন্দিন আবর্জনার প্রাথমিক শ্রেণিবিভাগ করা। তারপর যে সব বর্জ্য থেকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য কিছু বানানো যায়, তার ব্যবস্থা করা। শুধু বাড়ি বা রাস্তাঘাট নয়, হাসপাতাল, প্যাথলজির আবর্জনা প্রক্রিয়াকরণও সম্ভব। কলকাতা মহনগরীতে ইতিমধ্যে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তবে জেলার পুরসভাগুলি এ ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে। মেদিনীপুর, খড়্গপুর-সহ জেলার ৮টি পুরসভারই এক অবস্থা। জেলার সদর শহর মেদিনীপুরে আবর্জনা রীতিমতো সমস্যা। ঘিঞ্জি বসতি এলাকায় ভ্যাটের মধ্যে আবর্জনার পাহাড় জমে। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে তার পাশ দিয়েই শহরবাসীকে যাতায়াত করতে হয়। মেদিনীপুরে ঢোকার মুখে ধর্মার কাছে শহরের যাবতীয় আবর্জনা ফেলা হয়। ওই পথে যাতায়াতে সময় গা গুলিয়ে ওঠে। ফলে, পুর-এলাকায় এই প্রকল্পের দ্রুত রূপায়ণ জরুরি। কিন্তু তা হয়নি। মেদিনীপুরের পুরপ্রধান প্রণব বসুর বক্তব্য, “প্রকল্প তৈরি করতে অনেক খরচ। পুরসভার পক্ষে করা একটু কঠিন।’’ তবে পুর-পারিষদ (জজ্ঞাল) শিপ্রা মণ্ডল বলেন, “জৈব ও অজৈব আবর্জনা আলাদা করার কাজ প্রায় সব ওয়ার্ডেই শুরু হয়েছে। তবে এখনও তা থেকে সার তৈরি করা যায়নি। সেটাও করার চেষ্টা করছি।’’

কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিকাঠামো
তৈরির কাজ চলছে গড়বেতার সারবত পঞ্চায়েতে।

রেলশহর খড়্গপুরেও নানা স্থানে আবর্জনার স্তূপ জমছে। পর্যাপ্ত ভ্যাট নেই। তাই পুরসভা এলাকার আবর্জনা নিয়ে লোকালয়ের ফাঁকা মাঠে ফেলছে। ফলে, ছড়াচ্ছে দূষণ। বিগত কংগ্রেস বোর্ড খড়্গপুর আইআইটির সঙ্গে কথা বলে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপন পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু পুরবোর্ডে ক্ষমতার হাতবদল হতেই কাজ আর এগোয়নি। এখন তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড নতুন করে শক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপন পদ্ধতি চালু করতে জমি চেয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু জমি এখনও পায়নি। পুরপ্রধান প্রদীপ সরকার বলেন, “খড়্গপুর গ্রামীনের গোপালির কাছে একটা জমি পাওয়া গিয়েছে। তবে এখনও হস্তান্তর হয়নি। জমি পেলেই কাজ হবে। তাছাড়া আমরা রাজ্য থেকে দু’টি অত্যাধুনিক আবর্জনা ফেলার গাড়ি পাব। সেটি পেলেও আবর্জনার সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি পাবেন শহরবাসী।’’

পুরসভাগুলির এই পরিস্থিতির মধ্যে পঞ্চায়েতে কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। তাতে অবশ্য তোড়জোড় থেমে নেই। শালবনি গ্রাম পঞ্চায়েতের গোটকলাতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫৩ লক্ষ টাকা। এত টাকার সংস্থান হবে কী করে? পঞ্চায়েত প্রধান শক্তি দে-র কথায়, ‘‘আমাদের এখানে টাঁকশাল রয়েছে। রয়েছে কোবরা বাহিনীর অফিস। ফলে, প্রচুর বর্জ্য জমা হয়। তাই তাঁদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছি। বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছেও সাহায্য চাইছি।’’ পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে গড়বেতা-২ ব্লকের সারবত গ্রাম পঞ্চায়েতেও।

প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্বে রয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাতিষ্ঠানিক স্ব-শক্তিকরণ সেল, যারা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব উন্নয়নের কাজ করে। সেলের দায়িত্বে থাকা সন্দীপ সরকার বলেন, ‘‘প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুধু এলাকার পরিবেশের উন্নতি ঘটবে তা-ই নয়। লাভবান হবেন স্থানীয় কৃষকেরাও। আয় বাড়বে পঞ্চায়েতের। কারণ, ওখানে জৈব সারও তৈরি করা হবে।’’ প্রতিটি পরিবারকে দু’টি করে বালতি দেওয়া হবে। একটি সবুজ ও অন্য গোলাপি। সবুজ বালতিতে পচনশীল বর্জ্য থাকবে। গোলাপিতে থাকবে পচনশীল নয় এমন বর্জ্য। পচনশীল বর্জ্য দিয়ে তৈরি হবে সার। অপচনশীলের বর্জ্যে যদি লোহা, টিন জাতীয় কিছু থাকে তাহলে তা বিক্রি করবে পঞ্চায়েত। বাকি বর্জ্য জমি ভরাটের কাজে লাগবে। চাঁদড়া পঞ্চায়েতের প্রধান তারকনাথ বেরা বলেন, “আমরা পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করছি। মাস তিনেকের মধ্যে তা শেষ করে ফেলতে পারব।’’

ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন