গ্রামবাসী নিখরচায় জমি দিলেও হয়নি জলপ্রকল্প

জমি না মেলায় আটকে ছিল জল প্রকল্পের কাজ। জল সঙ্কট মেটাতে জমি দান করেন গ্রামেরই কয়েকজন বাসিন্দা। তারপরেও অবশ্য গ্রামে জল আসেনি। গড়বেতা-১ ব্লকের সন্ধিপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দাদের এখনও এক কিলোমিটার উজিয়ে জল আনতে হয়।

Advertisement

সুমন ঘোষ

গড়বেতা শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৫৬
Share:

শুধু এই পাম্পহাউসই তৈরি হয়েছে। —নিজস্ব চিত্র।

জমি না মেলায় আটকে ছিল জল প্রকল্পের কাজ। জল সঙ্কট মেটাতে জমি দান করেন গ্রামেরই কয়েকজন বাসিন্দা। তারপরেও অবশ্য গ্রামে জল আসেনি। গড়বেতা-১ ব্লকের সন্ধিপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দাদের এখনও এক কিলোমিটার উজিয়ে জল আনতে হয়।

Advertisement

ঘটনায় ক্ষুব্ধ জমিদাতা সদানন্দ সরকার, তাঁর বৌদি বন্দনা সরকার ও সুনীলকুমার মণ্ডল। বছর ছেষট্টির সুনীলবাবুর কথায়, “জমির টাকা নিলাম না। জলও পেলাম না! এ রকম হলে মানুষ যে দান করতেই উৎসাহ হারাবে। জমি দেওয়ার পরেও যদি প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে জল বয়ে আনতে হয়, তাহলে জমি দিয়ে কী লাভ।” সদানন্দবাবুও বলেন, “প্রকল্প তৈরি করতে হন্যে হয়ে জমি খুঁজতে হয় সরকারকে। সেখানে নিজেরা উদ্যোগী হয়েই জমি দিয়েছি। তারপরেও এলাকার মানুষ যদি পানীয় জল থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে চাষ যোগ্য জমি দান করে কী লাভ হল!”

এক ছটাক জমির জন্য যেখানে আটকে অনেক সরকারি প্রকল্পের কাজ, সেখানে জমি মেলার পরও কেন আটকে কাজ সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, দফতরে আর্থিক সঙ্কট থাকায় নতুন কোনও কাজ করা যাবে না বলে চলতি বছরের ১০ অগস্ট দফতরের পক্ষ থেকে নির্দেশিকা এসেছিল। সেই নির্দেশের পর এখনও নতুন কোনও নির্দেশ আসেনি। ফলে শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া অন্য কোনও কাজই হচ্ছে না।

Advertisement

জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের এগ্‌জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সুদীপ সেন বলেন, “প্রকল্প রূপায়ণে যে সামান্য অর্থ মিলেছিল, সেটুকু কাজ হয়েছে। পরে টাকা না মেলায় কাজ করা যায়নি।” সুদীপবাবু সম্প্রতি বদলিও হয়ে গিয়েছেন। জেলার বর্তমান এগ্‌কিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সত্যজিৎ পান বলেন, “আশা করি, এ বার নতুন প্রকল্পেও অর্থ পাব। তারপরই কাজ শুরু করতে পারব।”

গড়বেতা-১ ব্লকের সন্ধিপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের কাতরাবালি, সন্ধিপুর, খাঁপুর, বাছুয়া, হাটকুমারগঞ্জ, সীতানগর-সহ ১০টি গ্রামে পানীয় জলের সঙ্কট রয়েছে। গরমে জলের সমস্যা আরও বাড়ে। জলস্তর নেমে যাওয়ায় অগভীর নলকূপ থেকে জল ওঠে না। তখন ভরসা গভীর নলকূপ। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষেরই গভীর নলকূপ বসানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই।

যে ক’জনের আর্থিক অবস্থা ভাল, তারা চাষে সেচের জন্য মাঠে গভীর নলকূপ গড়েছেন। কখন সেচের পাম্প চলবে, গরমে গ্রামের বাসিন্দাদের সে জন্য হাপিত্যেশ করে থাকতে হয়। পাম্প চললেই সকলে ছোটেন হাঁড়ি-কলসী নিয়ে। কিন্তু যে দিন সেচের জন্য পাম্প চালানোর প্রয়োজন নেই! সে দিন পানীয় জল মিলবে কী ভাবে? কাতরাবালি গ্রামের প্রাক্তন শিক্ষক প্রদীপ বসু বলেন, “সকলে মিলে পাম্প মালিককে অনুরোধ করি। তিনি কিছুক্ষণের জন্য পাম্প চালান। গ্রামের সকলের জল নেওয়া হলে পাম্প বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া আর উপায় কী।”

এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে গ্রামে জল প্রকল্প গড়ার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানান স্থানীয়রা। কিন্তু প্রকল্প করতে তো জমির দরকার। তা জানার পরই কাতরাবিল গ্রামের সদানন্দ সরকার ও তাঁর বৌদি বন্দনা সরকার লিখিতভাবে প্রশাসনের কাছে আবেদন জানান যে, তাঁরা জল প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি দিতে ইচ্ছুক। তার জন্য কাতরাবালি মৌজায় ১৫ নম্বর দাগে ৪৮ ডেসিমেল জমিও চিহ্নিত করে দেন। কিন্তু ১০টি গ্রামে জল সরবরাহ করতে হলে এক জায়গায় জমি দিলে চলবে না। জমির প্রয়োজন সন্ধিপুরেও।

তখনই সন্ধিপুরের বাসিন্দা সুনীলকুমার মণ্ডলও ৮ ডেসিমেল জমি দিতে রাজি হয়ে যান। জমির সমস্যা নেই দেখে ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকল্পটি মঞ্জুরও করে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর। ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা। প্রকল্পের জন্য দু’টি এলাকায় ৪০ ডেসিমেল জমির প্রয়োজন পড়ে। সদানন্দবাবুরা ২০১৬ সালের ২৫ মে সেই জমিও ১ টাকার বিনিময়ে দান করেন।

জমি মেলার পর কাজ হয়েছে নামমাত্র। একটি মাত্র পাম্পহাউস তৈরি হয়েছে। আর কোনও কাজই এগোয়নি। ঘটনায় ক্ষোভ বাড়ছে জমিদাতাদের মধ্যে। তাঁদের প্রশ্ন, চাষ যোগ্য জমিতে চাষ না করে এলাকাবাসীর পানীয় জলের সঙ্কট মেটাতে দান করে কী লাভ হল। সদানন্দবাবুর অভিযোগ, “এই কারণেই জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরে বারবার যাচ্ছি। কবে প্রকল্পের কাজ হবে জানতে চাইছি। কোনও উত্তরই পাচ্ছি না। জমি দেব অথচ প্রকল্পও হবে না, এটা কি মানা যায়।” এ বার বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়ার কথাও ভেবেছেন সদানন্দবাবু। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীকে মানুষের জলকষ্টের বিষয়টি জানাব বলে ভেবেছি। আশা করি মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতে পারলে প্রকল্প গতি পাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন