অবসাদের অতলে

অবসাদ আর আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিদরা।

Advertisement

অভিজিৎ চক্রবর্তী

ঘাটাল শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৫১
Share:

অল্পবয়সী, বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই অনেক সময়ই মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে।

সংসার চালাতে ধার করতে হয়েছিল। ভেবেছিলেন সুযোগ মতো শোধ করবেন। তা তো হয়ইনি। উল্টে পরিবারের একজনের অসুস্থতার জন্য আবার ধার করতে বাধ্য হয়েছেন। সেই থেকে দুশ্চিন্তার শুরু। পরে ক্রমশ মানসিক অবসাদ গ্রাস করে ঘাটাল থানার মনসুকার বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ় মানস ঘোষ (নাম পরিবর্তিত)-কে। শেষমেশ কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

Advertisement

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, জীবনযাত্রার পট বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অবসাদ, বাড়ছে আত্মহননের ঘটনা। পরিসংখ্যানও সে দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াও বলছেন, “মানসিক অবসাদের জেরে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা সচেতন। খেলাধুলা করলে মানসিক চাপ কমে। তাই অল্পবয়সীদের মাঠে নামিয়ে চাপমুক্ত রাখার চেষ্টা হচ্ছে।”

আত্মহত্যার বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে অল্পবয়সী যুবক-যুবতী থেকে মাঝবয়সী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও হামেশাই নিজের জীবনে দাঁড়ি টানছেন। কারণ খুঁজতে গিয়ে কোথাও ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপড়েন, কোথাও বা জীবন-জীবিকার সঙ্কট সামনে আসছে। চাহিদার সঙ্গে না পাওয়ার দ্বন্দ্ব, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা থেকে শুরু করে রোগবালাইয়ের জেরেও অবসাদ বাড়ছে বলে মনোবিদরা জানাচ্ছেন। আর অল্পবয়সী, বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই অনেক সময়ই মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে।

Advertisement

ইতি জীবন

২০১৭-তে ২৯০

• ঘাটাল থানায় ১৯০
• চন্দ্রকোনা থানায় ৫৫
• দাসপুর থানায় ৪৫

২০১৮-তে ৩১৮

• ঘাটাল থানায় ২০১
• চন্দ্রকোনা থানায় ৬০
• দাসপুরে ৫৭

আত্মহত্যার এই পরিসংখ্যান ঘাটাল মহকুমার, তথ্য সূত্র: জেলা পুলিশ

এক স্কুল ছাত্রীর উদাহরণ দিয়ে জেলার মানসিক স্বাস্থ্য কমিটির নোডাল অফিসার রবীন্দ্রনাথ প্রধান জানালেন, ওই ছাত্রী সকালে দুটো টিউশন, স্কুলের পরে বাড়ি ফিরে কোনও ভাবে নাকেমুখে গুঁজেই ফের পড়তে যেত। বাড়ি ফিরে স্কুল, টিউশনের পড়া তৈরির ফাঁকে বাবা-মার বকুনি শুনতে হত তাকে। এ সবের মধ্যে পড়ে মানসিক অবসাদে বিধ্বস্ত হতে শুরু করে সে। সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার হাতছানি তো ছিলই। ক্রমে সেই ছাত্রীর আচরণে নানা অস্বাভাবিকতা নজরে পড়তে শুরু করে। তাকে মনোরোগের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান তার বাবা মা। বোঝা যায়, মেয়েটির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কাউন্সেলিংয়ের পরে সে এখন সুস্থ। বাবা-মাও ভুল বুঝেছেন। বুঝেছেন শৈশব-কৈশোর নষ্ট করে পড়াশোনার মাত্রাতিরিক্ত চাপে সন্তানের ক্ষতিই হয়।

একাধিক লোকের কাউন্সেলিং করেছেন এমন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, মানুষের জীবন-যাপনে একটা বড়সড় পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে গত কয়েক বছরের মধ্যে। অনেকেই দ্রুত পাল্টে যাওয়া সমাজ-পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তার প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিজীবনে। তা থেকেও অনেক ক্ষেত্রে গ্রাস করছে অবসাদ, তৈরি হচ্ছে আত্মহত্যার প্রবণতা।

অবসাদ আর আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিদরা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রসেনজিৎ বসাক বলছেন, চাপ কমাপে খেলাধুলো, গান শোনা, পরিজন-বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মন খুলে আড্ডা দেওয়া জরুরি। আর খেলার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা নয়, খেলতে হবে আনন্দ পেতে। অনেকটা ছোটবেলার মতো। ভাল বই পড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিদরা। মনে করাচ্ছেন বইয়ের থেকে বড় বন্ধু আর কিছু হয় না। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে অবসাদ দূরে রাখতে সামাজিক গঠনমূলক নানা কাজে মন দেওয়া, সুযোগ করে বেড়াদে যাওয়ার পরামর্শও বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন। আর সব থেকে জরুরি হল সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া আর নিজের মনকে বোঝানো— ভাল-মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লহ সহজে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন