ঐতিহ্যে আজও অমলিন পঁচেটগড়

প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরের থানা এলাকার পঁচেটগড় একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। পঁচেটগড় রাস উৎসবের জন্যই সকলের কাছে এক ডাকে পরিচিত। কিন্তু ইতিহাস বলছে, রাসের জাঁক এর অনেক আগে দুর্গোৎসবই ছিল এখানকার রাজ পরিবার তথা এলাকাবাসীর অন্যতম প্রধান উৎসব।

Advertisement

কৌশিক মিশ্র

এগরা শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৪০
Share:

প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরের থানা এলাকার পঁচেটগড় একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। পঁচেটগড় রাস উৎসবের জন্যই সকলের কাছে এক ডাকে পরিচিত। কিন্তু ইতিহাস বলছে, রাসের জাঁক এর অনেক আগে দুর্গোৎসবই ছিল এখানকার রাজ পরিবার তথা এলাকাবাসীর অন্যতম প্রধান উৎসব।

Advertisement

এমনটাই বলছেন, রাজ পরিবারের বর্তমান বংশধর সুব্রতনন্দন দাসমহাপাত্রও। প্রামাণ্য হিসেবে তিনি পঁচেটগড় থেকে প্রকাশিত ‘মন্দির তীর্থ পঁচেটগড়’ ও অমলেশ মিশ্রের অবিভক্ত কাঁথি মহকুমার ইতিহাস গ্রন্থের বিভিন্ন অংশ দেখিয়ে জানান, সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাটদের কাছ থেকে তাঁদের পূর্ব পুরুষ প্রথম দেহাত-গোকুলপুর এবং ভোগরাই পরগনার স্বত্ব লাভ করে পঁচেটগ্রামে জমিদারি সদর স্থাপন করেন। পরে মুঘল-পাঠানের যুদ্ধে পাঠানরা বিজয়ী হয়ে এই এলাকার মালিক হন। তারাও তাঁদেরই এই এলাকার শাসক হিসেবে মনোনীত করেন। পরে এই বংশের পূর্ব পুরুষ কালামুরারি মহাপাত্রর হাতে অধুনা পটাশপুরের পঁচেটগ্রামে পঁচেটগড়ের প্রতিষ্ঠা হয়।

রাজ পরিবার সূত্রে জানা যায়, পঁচেটগড়ের দুর্গোৎসবটি প্রায় পাঁচ শতকেরও বেশি প্রাচীন। বর্তমান রাজ পরিবারের বংশ-লতিকার কলেবর বৃদ্ধি ও প্রকৃত উৎসাহদাতার অভাব এবং আর্থিক দৈন্যতা আগের আড়ম্বরতাকে ম্লান করলেও রাজ-কৌলীন্যে ভরপুর পাঁচ শতকের প্রাচীন এই দুর্গোৎসব। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে আজও এলাকার পুরনো ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে রাজ পরিবারের পুজো। পঁচেট রাজবাড়ির প্রবীণ পরিচারক গোপাল চন্দ্র রায় বলেন, “ছোটবেলা থেকে এখানে রয়েছি। এলাকায় পুজো বলতে আগে রাজবাড়ির পুজোকেই বোঝাত। মূলত এই দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে গ্রামে সকলের ঘরে আসত আত্মীয়-পরিজন। তৈরি হত উৎসবের মেজাজ।”

Advertisement

রাজ পরিবারের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পরিবারটি আগে ‘মহাপাত্র’ হিসেবে ওড়িশার অধিবাসী ছিল। পঁচেটগড় প্রতিষ্ঠার পর তাঁরা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মহাপাত্র থেকে দাসমহাপাত্র হন। তাদের জমিদারিতে শিবের পুজোও হত। এর সাক্ষ্য দেয় পঁচেটগড়ের ‘পঞ্চেশ্বরের শিব মন্দির’। মহাপাত্র থেকে দাসমহাপাত্র হয়ে অর্থাৎ, বৈষ্ণব মতে দীক্ষার পরে পঁচেটগড়ে শিব-শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের মেলবন্ধন তৈরি হয়। স্থানীয়দেরও বক্তব্য, বর্তমানে মণ্ডপসজ্জা, আলোর রোশনাই, আতসবাজি, আধুনিক বাদ্যি-বাজনার দৌড়ে পিছিয়ে পড়লেও প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক ঘরানার এই পুজো আজও এলাকার গর্ব। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত এই পুজোকে কেন্দ্র করে পুজোর দিনগুলিতে শ’য়ে শ’য়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষের সমাগম ঘটে। বৈষ্ণবধর্মাবলম্বী রাজ পরিবার থেকে জানা যায়, এই দুর্গোৎসবে দেবী মৃন্ময়ী না হয়ে পটিয়সী রূপে পূজিতা হন। স্থায়ী মণ্ডপের ওপরে শিব, ডান পাশে লক্ষ্মী ও গণেশ এবং বাম পাশে সরস্বতী ও কার্তিককে নিয়ে দুর্গা বিরাজ করেন। তিনি বৈষ্ণব উপাচারে পূজিতা হন।

পুরনো অনেক প্রথাই এখন লোপ পেয়েছে। কিন্তু বর্তমানের ছোট-বড় নানা পুজোয় থিমের দাপট দেখা গেলেও পঁচেটগড়ের রাজ পরিবারের দুর্গোৎসব আজও প্রাচীন এবং বনেদি ঘরানাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ধরে রেখেছে লুপ্ত সামন্ততান্ত্রিক ঐতিহ্য ও প্রাচীনত্বের গর্বকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন