ঘাটাল মহকুমা আদালত। —নিজস্ব চিত্র।
আড়াই ও দেড় বছরের দুই শিশুকন্যাকে শ্বাসরোধ করে খুন করেছিল বাবা। পরে নদীর চরে দেহ দু’টি পুঁতে ফেলে ফিরে এসেছিল বাড়িতে। সানে তিন বছর আগের এই ঘটনায় আলোড়ন পড়েছিল ঘাটালে। গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই ঘটনারই রায় ঘোষণা হল শুক্রবার। অভিযুক্ত রাকেশ সিংহকে ফাঁসির সাজা শোনালেন ঘাটাল আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক দেবপ্রসাদ নাথ।
এ দিন ঘড়িতে তখন বেলা আড়াইটে। বিচারক সাজা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস তৈরি হয়ে গেল ঘাটাল আদালতে। কারণ, এই প্রথম ঘাটালের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতে কোনও ফাঁসির আদেশ হল। খবরটা জানাজানি হতেই আদালত চত্বরে আলোড়ন পড়ে যায়। আইনজীবী থেকে আদালতে সব স্তরের কর্মীদের মুখে মুখে দিনভর ওই একটি ঘটনারই চর্চা হয়েছে এ দিন। ঘাটাল আদালতে এমন ঐতিহাসিক রায়ের পরে আইনজীবী তথা ‘ঘাটাল বার অ্যসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক নিত্যানন্দ ভুঁইয়ার প্রতিক্রিয়া, “শিশু ও মহিলাদের উপরে যারা অত্যাচার করে, এই রায় তাদের প্রতি একটা কড়া বার্তা।” ঘাটাল আদালতের প্রবীণ থেকে নবীন আইনজীবী তপন রায়, দিলীপ দাস, গোকুলচন্দ্র মাঝি, সুদীপ রায়, রামপদ দে, তপন ভট্টচার্যরাও বলেন, “শিশুকন্যাদের যৌন নিযার্তন, খুন, মহিলাদের উপর আক্রমণের মতো নানা ঘৃণ্য অপরাধ সমাজে ঘটছে। এমন দৃষ্টান্তমূলক রায়ের পরে এই ধরনের কাজ করার আগে অপরাধীরা অন্তত এক বার ভাববে।”
ঘাটাল শহরের কোন্নগরের বাসিন্দা রাকেশ ২০১১ সালের ১২ মার্চ তার দুই শিশুকন্যা অনুরাগ ও তনুরাগকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে শিলাবতী নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করে বলে আদালতে প্রমাণ হয়েছে। খুনের পর কচি শরীর দু’টো নদীর চরে পুঁতে বালি চাপাও দিয়ে দিয়েছিল রাকেশ। বাড়ি ফেরার পরে স্ত্রী সুধা মেয়েদের কথা জানতে চাইলে ধারাল অস্ত্রে ঘায়েল করেছিল তাঁকেও।
ওই ঘটনার পর রাকেশের শাস্তির দাবিতে সরব হয়েছিলেন প্রতিবেশীরা। সুধা নিজেও স্বামীর শাস্তি চেয়েছিলেন। ঘটনার পরে বিহারের ছাপরা জেলার ভেলহারি গ্রামে ফিরে গেলেও আদালতে এসে স্বামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন সুধা। ঘাটাল থানার তৎকালীন সিআই তথা বর্তমানে আইসি, বড়জোড়া অসিত সামন্ত এবং তৎকালিন ওসি তুলসী ভট্টাচার্য বলেন, “ঘটনার রাতেই পাড়ার লোক থানায় জড়ো হয়েছিল। রাকেশের ফাঁসির দাবি তুলেছিল।” এই পুলিশ আধিকারিকদের মতে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, পুলিশের তদন্ত, তথ্য প্রমাণ সবই ছিল রাকেশের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে স্ত্রী সুধার সাক্ষ্যদান মামলার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে সহায়তা করে।
২০০৩ সালে ঘাটালে চালু হয় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট। ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল তা রূপান্তরিত হয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতে। ঘাটালে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক চালু হওয়ার পর একাধিক মামলায় অভিযুক্তের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ হয়েছে। তবে মৃত্যুদণ্ডের সাজা এই প্রথম।
ঘাটাল আদালতের প্রবীণ আইনজীবী তথা এই মামলার প্রাক্তন সরকারি আইনজীবী (প্রথমে সরকারি পিপি-র দায়িত্বে ছিলেন) মনোরঞ্জন মণ্ডল বলেন, “যে মামলায় এমন দৃষ্টান্তমূলক সাজা ঘোষণা হল, তার সরকারি আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় ভাল লাগছে ছিলাম।” মামলার সরকারি আইনজীবী চিত্তরঞ্জন কর্মকারেরও বক্তব্য, “এই মামলার জন্য মাসের পর মাস ভাল ভাবে ঘুমোতে পারিনি। অভিযুক্তের স্ত্রীকে বিহার থেকে নিয়ে আসতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১ এবং ৩২৬ ধারয় মামালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিচারক ফাঁসির সাজা শুনিয়েছেন।”
ঘাটাল শহরের মোড়ে মোড়েও এ দিন একমাত্র আলোচ্য রাকেশ সিংহের ফাঁসির আদেশ। ঘাটাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক প্রাণেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলেজের বর্তমান টিচার ইন-চার্জ লক্ষ্মীকান্ত রায়ের মতে, “এই ধরনের সাজা সমাজের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর কেউ শিশুদের উপর অত্যাচার বা খুন-সহ অসামাজিক কাজ করতে একটু হলেও ভয় পাবে। অপরাধ প্রবণতা সামান্য হলেও কমবে।” ঘাটাল শহরের বাসিন্দা শিক্ষিকা রুপা হালদারের কথায়, “এই রায়ে কিছুটা স্বস্তি বোধ হচ্ছে। আশা করব এরপর সমাজে এই ধরনের কাজ বন্ধ হবে।” ঘাটাল শহরের আর এক বাসিন্দা অশোক সেনগুপ্ত বলেন, “যে বাবা দুই শিশুকে নির্মম ভাবে খুন করে বালি চাপা দিয়ে দিব্বি বাড়িতে এসে ঘুমিয়ে পড়তে পারে, তার এই শাস্তিই প্রাপ্য। এজ় সবের পরে মনে হয় আদালতই আমাদের ভরসা।”