চোলাই ঠেকের রমরমা, প্রতিবাদী শিক্ষককে হেনস্থা

গ্রামে চোলাই মদ তৈরির প্রতিবাদ করায় অবসরপ্রাপ্ত এক স্কুল শিক্ষককে হেনস্থার অভিযোগ উঠল কোলাঘাটে। অভিযোগ, বৃহস্পতিবার রাতে কমলকান্ত দোলই নামে ওই শিক্ষকের পুকুরে কীটনাশক দেওয়ায় মাছ মরে ভেসে ওঠে। ওই শিক্ষকের বাড়ির সামনে আবর্জনা ফেলারও অভিযোগ ওঠে। শুক্রবার কোলাঘাট থানার কুমারহাট গ্রামের ওই ঘটনায় স্থানীয় এক চোলাই ব্যবসায়ী বীনা সিংহের বিরুদ্ধে কোলাঘাট থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তমলুক শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৪ ০০:৩৬
Share:

পুকুরে ভেসে উঠেছে মরা মাছ। (ইনসেটে) কমলকান্ত দোলই। নিজস্ব চিত্র।

গ্রামে চোলাই মদ তৈরির প্রতিবাদ করায় অবসরপ্রাপ্ত এক স্কুল শিক্ষককে হেনস্থার অভিযোগ উঠল কোলাঘাটে। অভিযোগ, বৃহস্পতিবার রাতে কমলকান্ত দোলই নামে ওই শিক্ষকের পুকুরে কীটনাশক দেওয়ায় মাছ মরে ভেসে ওঠে। ওই শিক্ষকের বাড়ির সামনে আবর্জনা ফেলারও অভিযোগ ওঠে। শুক্রবার কোলাঘাট থানার কুমারহাট গ্রামের ওই ঘটনায় স্থানীয় এক চোলাই ব্যবসায়ী বীনা সিংহের বিরুদ্ধে কোলাঘাট থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও অভিযোগ, আবগারি দফতর ও পুলিশের একাংশের নিষ্ক্রিয়তার দরুণ চোলাইয়র রমরমা বাড়ছে।

Advertisement

আগেও চোলাই ঠেক ভাঙা নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় নানা ঘটনার নজির রয়েছে। মাসখানেক আগে নন্দকুমার থানার রাজনগর গ্রামে এক নাবালিকা স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় জনতার রোষ গিয়ে পড়ে স্থানীয় মদের ভাটির উপর। গণধোলাইয়ে এক জনের মৃত্যু হয়। কয়েকদিন আগে আবগারি দফতরের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে এগরায় স্থানীয় মহিলারাই মদের ঠেক ভাঙতে মাঠে নামে। এ দিনের এই ঘটনা ফের প্রমাণ করে দিল, জেলায় চোলাই মদের ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য অব্যাহত।

কোলাঘাট থানা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে দেউলিয়া-খন্যাডিহি পাকা রাস্তার ধারে কুমারহাট গ্রামের বাসিন্দা প্রৌঢ় কমলকান্তবাবু দেউলিয়া হীরারাম উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক। এ দিন সকালে কুমারহাট গ্রামে গিয়ে দেখা যায় দেউলিয়া কমলবাবুর দোতলা পাকাবাড়ির সামনে পুকুরের জলে অসংখ্য মরা মাছ ভেসে রয়েছে। পুকুরের অপর পাড়ে থাকা অধিকাংশ বাড়ির আশেপাশে বাঁশের কাঠামো ও ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া ঘর রয়েছে। অভিযোগ, ওইসব ঘরেই চোলাই মদ তৈরির কাজ চলে। কমলবাবু বলেন, “প্রায় ২০ বছর ধরে চোলাই মদ তৈরির সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলিকে এই কারবার থেকে সরিয়ে আনার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওরা নানা অজুহাত দেখিয়ে চোলাই মদ তৈরির কারবার থেকে সরে আসেনি।” উল্টে ওই পরিবারগুলিতে বিবাহ সূত্রে আসা আত্মীয়রাও মদ তৈরির ব্যবসা শুরু করায় দিনে দিনে গ্রামে চোলাইয়ের রমরমা বেড়েছে বলে জানান তিনি।

Advertisement

কমলবাবুর অভিযোগ, “মদের ভাটি থেকে উৎপন্ন বর্জ্য পাশের পুকুরে ফেলার ফলে জল দূষিত হচ্ছে। ওই বর্জ্য পাশের চাষ জমিতে মিশে যাওয়ার ফলে ক্ষতি হচ্ছে ধান-সহ বিভিন্ন ফসলের।” গত রবিবার স্থানীয় বাসিন্দারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়, গ্রামে চোলাই মদ তৈরি বন্ধ করতে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে একসাথে অভিযোগ জানানো হবে। সোমবার কোলাঘাট থানায় অভিযোগ জানানো হয়। ওই দিন রাতেই পুলিশ কিছু মদের ভাটি ভেঙে দেয়। কমলবাবু অভিযোগ করেন, “গত মঙ্গলবার রাতে বাড়ির প্রধান প্রবেশপথের দরজায় কেউ নোংরা আবর্জনা ফেলে দিয়ে যায়। ওই দিন রাতেই কোলাঘাট থানায় পুলিশের কাছে এবিষয়ে অভিযোগ জানাই। রাতেই পুলিশ তদন্তে আসে। এরপর বুধবার পাড়ার এক চোলাই মদের কারবারি ছেলেকে, কী করে পুকুরে মাছ করিস দেখে নেব বলে হুমকি দেয়। তারপর বৃহস্পতিবার রাতে আমার পুকুরের জলে কীটনাশক ফেলা হয়েছে।” স্থানীয় বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ মান্না, সন্তোষ মান্নাদেরও অভিযোগ, কমলবাবুর নেতৃত্বে প্রশাসনের কাছে চোলাই ঠেক নিয়ে অভিযোগ জানানোর পর মদের কারবারিরাই এমন কাজ করেছে। সিপিএম পরিচালিত স্থানীয় পুলশিটা পঞ্চায়েতের প্রধান প্রীতিকণা দরা বলেন, “শিক্ষককে হেনস্থার ঘটনা সমর্থনযোগ্য নয়। তবে ওই এলাকার মদের ভাটির উচ্ছেদে পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে এখনও উদ্যোগ নেওয়া যায়নি, এটা ঠিক। প্রয়োজনে এবিষয়ে সবরকম সহযোগিতা করা হবে।”

যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে চোলাই ব্যবসায়ী বীনা সিংহ বলেন, “পুকুরে বিষ দেওয়ার ঘটনা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।” তাঁর পাল্টা দাবি, আমরা দীর্ঘ দিন ধরে মদ তৈরির কাজ করছি, এটা পুলিশ-প্রশাসন জানে। আমাদের কাছ থেকে আবগারি দফতর, পুলিশ ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন দলের লোকেরা এজন্য টাকাও নেয়। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও অভিযোগ, আগে স্থানীয় সিপিএম নেতাদের ও বর্তমানে শাসকদলের প্রশয়ে মদের ভাটির মালিকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যদিও স্থানীয় তৃণমূল নেতা কাঞ্চন মণ্ডল দাবি করেন, গ্রামের ওই চোলাই মদের কারবারিদের বুঝিয়ে মদ তৈরির ব্যবসা বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এখনও অনেকেই তা ছেড়ে আসছে না। এজন্য আমরা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।

আবগারি দফতরের নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ প্রসঙ্গে দফতরের জেলা সুপারিন্টেডেন্ট তপনকুমার মাইতি বলেন, “ কুমারহাট গ্রামে প্রচুর চোলাই মদ তৈরির ভাটি থাকার বিষয়টিতে আমরা নজর রেখেছি। ওই গ্রামে মদের ভাটি ভাঙার জন্য নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। এরআগে অনেকেই গ্রেফতারও হয়েছে।” তাঁর দাবি, আমাদের লোকবল কম থাকায় অভিযানের কাজে অসুবিধা হচ্ছে। আর অভিযান চালানোর কিছুদিন পরেই ভাটি মালিকরা ফের মদ তৈরির কারবারে নেমে যাচ্ছে। ফলে ওখানে মদ তৈরির কারবার পুরোপুরি বন্ধ করতে পারা যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা এগিয়ে এলে আমাদের পক্ষে এই কাজে সুবিধে হবে। জেলা পুলিশ সুপার সুকেশকুমার জৈন বলেন, “কুমারহাট গ্রামে মদের ভাটির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। কয়েকদিন আগেও ওই গ্রামে অভিযান চালিয়ে ভাটি ভেঙে দেওয়া হয় ও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর জেরেই এ দিন পুকুরে বিষ দেওয়ার ঘটনা কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” তবে মদের ভাটির মালিকের কাছ থেকে পুলিশের টাকা নেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন