বিদ্যাসাগর হলে ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
পেটাই চেহারা। কোনও আড়ষ্টতা ছাড়াই খেলার নিয়মে এক কুইন্টালেরও বেশি ভার তুলে নিচ্ছেন চোখের নিমেষে। সেরা ঘোষণা হওয়ার পর আনন্দের হাসিটুকুই পাওনা। কিন্তু আলো ঝলমল মঞ্চের বাইরের জীবনে এলেই এই আনন্দ মুহূর্তে বদলে যায় দুশ্চিন্তায়। জাতীয় স্তরের পুরস্কারের পর আন্তর্জাতিক স্তরে যোগ দিতে পারা নিয়েও রয়ে যায় সংশয়। এমনই অবস্থা ঊনত্রিশে পা দেওয়া রাজ্য স্ট্রেংথ লিফটিং ফেডারেশনের সদস্যদের।
সংস্থা সূত্রে জানা দিয়েছে, ১৯৮৫ সালে রাজ্যের ভারোত্তোলকদের আন্তর্জাতিক স্তরে যোগদানে উৎসাহ দিতে জন্ম হয়েছিল এই সংস্থার। অথচ সংস্থার সভাপতি দীনবন্ধু দাসের কথায়, “কেন্দ্রের কোনও সরকার এতদিন আমাদের সাহায্য করেনি। তবে নতুন সরকার আসার পর ছবিটা কিছুটা বদলেছে।” তিনি জানান, গত বছর হরিয়ানায় জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় রাজ্য সেরা হওয়ায় ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এবার মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট স্ট্রেংথ লিফটিং অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে মেদিনীপুর শহরের বিদ্যাসাগর হলে জাতীয় স্তরের ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এখানের বাছাই করা ভারোত্তোলকরা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুবাইয়ের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যোগ দেবেন। মেদিনীপুরের এই প্রতিযোগিতাতেও রাজ্য সরকার ১ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে বলে জানালেন সংগঠনের জেলা সভাপতি প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী।
ভরসা সেটুকুই।
মেদিনীপুরের এই প্রতিযোগিতায় দেশের ২২টি রাজ্যের প্রায় সাড়ে ৩০০ জন প্রতিযোগী যোগ দিয়েছেন। তাঁদের হোটেলে রাখা তো দূর, রাখা হয়েছে খুব সাধারণ জায়গায়। বরাদ্দ হয়নি ভাল খাবারও। বাজেট কমিয়ে আনা হয়েছে সাড়ে ৬ লক্ষ টাকায়। রবিবার প্রতিযোগিতার শেষ দিন। এখনও সব টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। প্রায় ২ লক্ষ টাকা ধার। প্রসেনজিৎবাবুর কথায়, “এ বার উৎসাহ দিতে রাজ্য সরকার ১ লক্ষ টাকা দিয়েছে। বাকিটা অন্যদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে করার চেষ্টা করছি।”
সংস্থার সভাপতি দীনবন্ধু দাস জানালেন, এ রাজ্যের ভারোত্তোলকদের অর্থাভাব এতটাই যে, ছত্তীসগঢ়, সিকিম-সহ বহু রাজ্যের ভারোত্তোলকরা ট্রাকস্যুট পরে এলেও, তাঁদের অনেকের সেটুকুও জোটেনি। যে কোনও খেলার মতো ভারোত্তোলকদেরও সম্পদ হল স্বাস্থ্য। অথচ এই খেলার সঙ্গে যুক্ত এ রাজ্যের অনেকেই সামান্য পুষ্টিকর খাবারটুকুও জোগাড় করতে পারেন না। একথা স্বীকার করে ফেডারেশনের সর্বভারতীয় সভাপতি বাবুল বিকাশ পত্রনবীশ বলেন, “সরকারি সাহায্য না পেলে সাফল্য মিলবে না।”
দুর্দশার কাহিনী শোনাচ্ছেন জাতীয় স্তরের কৃতীরাও। একাধিকবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ও একবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের শিরোপা পাওয়া মঞ্জুরী ভাস্করের কথায়, “যা রোজগার করি তাতে প্রতিযোগিতায় যোগ দিতেই অংশ নিতেই শেষ হয়ে যায়।” পেট চালাতে তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী চাকরি করেন, সঙ্গে ফিজিওথেরাপিও করান।
দুর্দশার মধ্যে রয়েছে রাজ্য স্ট্রেংথ লিফটিং ফেডারেশনও। সংগঠনের কোনও অফিস নেই। যাঁরা দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরা নিজেদের বাড়িতে অফিস চালান। সর্বত্র প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও নেই। যেমন, মেদিনীপুরেই প্রতিযোগিতা করাতে সরঞ্জাম আনতে হয়েছে হুগলির বাঁশবেড়িয়া থেকে। সংস্থার সভাপতির কথায়, “সব দুঃখের কথা কী জানেন, আমরা যাঁকে স্বর্ণপদক বলি তাতে সোনার ছোঁওয়া পর্যন্ত থাকে না। কম দামি খাঁটি ধাতুও দিতে পারি না। একটা স্মারক ও শংসাপত্রটিই সম্বল।’’