ধুলো জমছে সপ্তদশ শতকের নিমকমহলে

মলিন ঐতিহ্য। অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে কাঁথির বহু প্রাচীন সৌধ। স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কাঁথির গৌরবময় অবদান রয়েছে। ‘বিপ্লবতীর্থ’ নামে পরিচিত কাঁথির প্রথম মহকুমাশাসকের প্রাচীন অফিস ‘বড়কুঠি’ প্রশাসনিক উদাসীনতায় আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা সময়ে প্রশাসনের কাছে বড়কুঠিকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করার আবেদন জানানো হয়েছে। তারপরেও শুরু হয়নি সংস্কারের কাজ।

Advertisement

সুব্রত গুহ

কাঁথি শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৪ ০০:১০
Share:

সংরক্ষণের অভাবে জীর্ণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের নিমকমহলের।

মলিন ঐতিহ্য।

Advertisement

অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে কাঁথির বহু প্রাচীন সৌধ। স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কাঁথির গৌরবময় অবদান রয়েছে। ‘বিপ্লবতীর্থ’ নামে পরিচিত কাঁথির প্রথম মহকুমাশাসকের প্রাচীন অফিস ‘বড়কুঠি’ প্রশাসনিক উদাসীনতায় আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা সময়ে প্রশাসনের কাছে বড়কুঠিকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করার আবেদন জানানো হয়েছে। তারপরেও শুরু হয়নি সংস্কারের কাজ।

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা কাঁথির উত্‌পত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রাক্তন কালেক্টর ও প্রত্নতত্ত্ববিদ এইচ ভি বেলিও’র মতে, খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতাব্দীতে প্রবল বন্যায় ওড়িশার চিলিকা হ্রদের একদিকে যেভাবে বালুকাময় ভূমিখণ্ড গঠিত হয়েছিল, ঠিক তেমনভাবেই এককালে অজস্র বালিয়াড়ি ভরা কাঁথি মহকুমার ভূখণ্ডও গঠিত হয়। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন মানচিত্রে কাঁথি নামে কোনও স্থানের উল্লেখ ছিল না। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্টিনের বাংলাদেশের মানচিত্রে বঙ্গোপসাগরের উপকূলভাগে ‘কেন্দুয়া’ নামে যে স্থানকে চিহ্নিত করা হয়, সেই জায়গাটিই হল আদি কাঁথি। ভাষাতত্ত্ববিদ যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, “কাঁথির বিস্তৃত অঞ্চলে বালুয়াড়ি বা বালির দেওয়াল (কাঁথ) থাকায় সেই নাম থেকেই কাঁথি নামকরণ করা হয়েছে।”

Advertisement

সপ্তদশ শতকের শেষভাগেও কাঁথি তেমন প্রসিদ্ধ জায়গা ছিল না। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে লবণ ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে কাঁথি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে লবণ ব্যবসার স্বার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাঁথির (তখনও কাঁথি নামকরণ হয়নি) পূর্ব কুমারপুর মৌজায় লবণ ব্যবসার এজেন্ট অফিস তৈরি করে। ১৭৮৮ সালে কোম্পানির ‘সল্ট এজেন্ট’ হিসেবে এন ডবলিউ হিউয়েট নিযুক্ত হওয়ার পর কাঁথিতেই লবণ ব্যবসার স্থায়ীকেন্দ্র হিসেবে নিমকমহল তৈরি করে কাঁথি ও হিজলি পরগনায় লবণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উদ্যোগী হন। হিজলি পরগনার মাজনামুঠার রাজা যাদবরাম রায়ের রানি সুগন্ধাদেবীর কাছ থেকে বার্ষিক এক টাকা খাজনার শর্তের বিনিময়ে পূর্ব কুমারপুর, আঠিলাগড়ি, পশ্চিম কুমারপুর-এই তিনটি মৌজার ৩০৫ বিঘা জমি কিনে নিমকমহল তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। পরে ডনির্থন নামে আর একও ‘সল্ট এজেন্ট’ ওই জমির উপর তিন তলা প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেন। কথিত আছে, ডনির্থন সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে এদেশে আসা বাণিজ্য জাহাজগুলির ভারসাম্য রাখার জন্য ব্যবহৃত ব্যাসাল্ট ইট দিয়ে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। পরে এই বাড়িটি নিমকমহল বা বড়কুঠি নামে খ্যাতি লাভ করে।

নিমকমহলের নির্মাণশৈলী থেকেই বোঝা যায়, সওদাগরি অফিসের ধাঁচেই এই কুঠিটি তৈরি হয়েছিল। ওই কুঠীর এক তলায় অফিসের কাজকর্ম চলত। দোতলা আর তিনতলায় ছিল লবণ ব্যবসার কাজে নিযুক্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বাসভবন। ১৮৫২ সালে কাঁথি মহকুমা গঠিত হয়। তবে তারপরেও বেশ কিছুদিন নেগুয়াতেই কাঁথির মহকুমা শাসকের অফিস চালু ছিল। প্রায় ১১ বছর পরে ১৮৬৩ সালে নেগুয়া থেকে মহকুমাশাসকের অফিস পাকাপাকিভাবে উঠে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিমকমহলের পরিত্যক্ত বড়কুঠিতে। ইংরেজ সরকার ওই জমি ও বড়কুঠি লবণ এজেন্ট ডনির্থনের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকায় কিনে নিয়ে মহকুমাশাসকের কাছারী, বাসভবন ও উদ্যান তৈরি করে। ১৯৪২ সালে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বড়কুঠি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বড়কুঠির প্রথম ও দ্বিতীয় তলার একাংশ ভেঙে পড়ে। ক্ষতি হয় তৃতীয় তলারও। বর্তমান কাঁথি মহকুমাশাসকের অফিস চত্বরের পাশে অতীত ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বড়কুঠি। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বড়কুঠিতে কাঁথির ফৌজদারি আদালত ও মহকুমা শাসকের কিছু দফতরের কাজকর্ম চলত। দীর্ঘ দিন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ কুঠিটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।

কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও ‘হিজলীনামা’ গ্রন্থের লেখক প্রেমানন্দ প্রধানের কথায়, “প্রশাসনিক উদ্যোগ ও স্থানীয় মানুষের উদ্যমের অবাবে শতাব্দী প্রাচীন এই বড়কুঠির গৌরবময় ইতিহাস আজ বতর্মান প্রজন্মের কাছে নক্কারজনক উপহাসে রূপান্তরিত হয়েছে। অবিলম্বে সরকার ও হেরিটেজ কমিশনের পক্ষ থেকে কাঁথি ও হিজলি পরগনার ঐতিহাসিক স্মৃতি বিরজিত বড়কুঠিকে হেরিটেজ ঘোষণা করে উপযুক্ত সংরক্ষণ করার দরকার।”

মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ও সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতি বিজড়িত কাঁথি জাতীয় বিদ্যালয়ও অবহেলার শিকার। সর্বশিক্ষা মিশনের অর্থে নতুন বিদ্যালয় ভবন তৈরি হলেও প্রাচীন ভবনের জীর্ণ দশা। মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থের অন্যতম লেখক ও মুগবেড়িয়া কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ হরিপদ মাইতির দাবি, অবিলম্বে জাতীয় বিদ্যালয়ের পুরনো ভবন সংরক্ষণ করে সেখানে জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ও বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নামে একটি সংগ্রহশালা তৈরি করা হোক। কাঁথি শহরের বাসিন্দা তথা রাজ্যের সমবায়মন্ত্রী জ্যোতির্ময় কর জানান, অসহযোগ আন্দোলনের সময় মেদিনীপুর জেলায় যে ১২টি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কাঁথি জাতীয় বিদ্যালয় তার অন্যতম। ১৯২১ সালে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ডাকে সাড়া দিয়ে কাঁথি হাইস্কুল, মডেল ইনস্টিটিউশন-সহ মহকুমার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্ররা নিজেদের স্কুল ছেড়ে বেড়িয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ইংরেজদের তৈরি স্কুলের বদলে স্বদেশী ভাবনায় লেখাপড়ার জন্য কাঁথিতে জাতীয় বিদ্যালয় তৈরির চিন্তা করা হয়। ১৯২১ সালের ৭ মার্চ কাঁথির সরস্বতীতলায় বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের বাড়িতেই শুরু হয় জাতীয় বিদ্যালয়। ১৯২৫ সালে জাতীয় বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ পাহাড়ি স্কুলের জন্য কাঁথি ক্যানাল পাড়ের কাছে ব্যক্তিগত দু’বিঘা জমি দান করেন। পরে সাধারণ মানুষের অর্থ সাহায্যে এখানেই নতুনভাবে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ওই বছরের ৫ জুলাই প্রথমবার কাঁথি শহরে এই বিদ্যালয়েই ছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেম রাজেন্দ্রপ্রসাদ, মথুরা প্রসাদও।

১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় এই বিদ্যালয়েই সত্যাগ্রহ শিবির গড়ে উঠেছিল। তত্‌কালীন অবিভক্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সত্যাগ্রহীরা আশ্রয় নেন। শিবিরে সরকার বিরোধী কাজের জন্য ১৯৩০ সালের ৭ মে ব্রিটিশ পুলিশ জাতীয় বিদ্যালয়ে হানা দিয়ে সত্যাগ্রহীদের গ্রেফতার করে। সেই সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলেও পরে ফের সেটি চালু হয়। কিন্তু ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ফের ওই বিদ্যালয়ে বিপ্লবীদের শিবির গড়ে ওঠায় ব্রিটিশ সরকার স্কুলটিকে বেআইনি ঘোষণা করে। ১৯৪২ সালের ঘূর্ণিঝড়ে স্কুলটির ক্ষতি হয়। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে স্কুলের এক কোণে একটি স্মারক গৃহ তৈরি করা হয়। বিদ্যালয়ের বতর্মান সম্পাদক শুভাশিস পণ্ডার অভিযোগ, “তারপরে স্কুলের ভাগ্যে আর শিকে ছেঁড়েনি।” বিদ্যালয়ের আর এক প্রাক্তন সম্পাদক ও প্রাক্তন কাউন্সিলার জগদীশ দীণ্ডার উদ্যোগে বিদ্যালয়ের একটি তোরণও তৈরি করা হয়। তবে কাজ বলতে ওইটুকুই। তাঁদের দাবি, জাতীয় বিদ্যালয়ের অবশিষ্ট অংশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মারক হিসেবে সংরক্ষিত করে সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হোক।

ছবি: সোহম গুহ।

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু

বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।

subject-এ লিখুন ‘আমার শহর মেদিনীপুর’।

ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:

www.facebook.com/anandabazar.abp

অথবা চিঠি পাঠান

‘আমার শহর’,

পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগ,

জেলা দফতর,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন