নেতাদের দুর্নীতির প্রতিবাদ, দুই তৃণমূল প্রধানকে হুমকি

দলীয় নেতৃত্বের একাংশের মদতে দুর্নীতি চলছে আর তার প্রতিবাদ করায় দেওয়া হচ্ছে প্রাণনাশের হুমকি, এমনই অভিযোগে সরব হয়েছেন তৃণমূলের দুই পঞ্চায়েত প্রধান। হুমকির জেরে শাসক দলের ওই দুই জনপ্রতিনিধিকে এলাকাছাড়া হতে হয়েছে বলেও অভিযোগ।

Advertisement

সুমন ঘোষ ও অভিজিৎ চক্রবর্তী

গড়বেতা শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৪ ০৩:০৫
Share:

দলীয় নেতৃত্বের একাংশের মদতে দুর্নীতি চলছে আর তার প্রতিবাদ করায় দেওয়া হচ্ছে প্রাণনাশের হুমকি, এমনই অভিযোগে সরব হয়েছেন তৃণমূলের দুই পঞ্চায়েত প্রধান। হুমকির জেরে শাসক দলের ওই দুই জনপ্রতিনিধিকে এলাকাছাড়া হতে হয়েছে বলেও অভিযোগ।

Advertisement

অভিযোগকারী দুই প্রধানই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতার। একজন গড়বেতা-১ ব্লকের আমলাগোড়া পঞ্চায়েতের প্রধান শোভা বসু। অন্যজন গড়বেতা-৩ ব্লকের কড়সা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কবিরুল ইসলাম। শোভাদেবী গত ২৫ মে থেকে ঘরছাড়া ছিলেন। গোটা ঘটনা তিনি মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত ভাবে জানান। তারপর শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। এলাকায় ফিরে কাজও শুরু করেছেন এই মহিলা প্রধান। তবে আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি। শোভাদেবীর কথায়, “রাজ্য নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মিটেছে ঠিকই, তবু মনে ভয় রয়েছে।”

১৬ মে থেকে ঘরছাড়া কবিরুল এখনও এলাকায় ফেরেননি। কখনও কলকাতায়, কখনও মেদিনীপুরে থাকছেন। কবিরুল দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে সব জানিয়েছেন। মুকুলবাবু বলেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে। কবিরুলও ফিরে যাবেন। দলে কোনও অশান্তি নেই।”

Advertisement

পঞ্চায়েতের কাজের ক্ষেত্রে তৃণমূলের এই দুই পঞ্চায়েত প্রধানের অভিজ্ঞতা অনেকটা একই রকম। দু’জনেরই বক্তব্য, তাঁরা পঞ্চায়েতের কাজে স্বচ্ছতা আনতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি রুখতে চেয়েছিলেন। আর তাতেই দলীয় নেতৃত্বের একাংশের কোপে পড়েন। আমলাগোড়ার পঞ্চায়েত প্রধান শোভাদেবী অভিযোগের আঙুল তুলেছেন দু’জনের দিকে তৃণমূলের গড়বেতা ১ ব্লক সভাপতি দিলীপ পাল এবং দলের জেলা কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষ। অভিযোগ, এঁদের মদতেই আমলাগোড়া পঞ্চায়েতে বিস্তর দুর্নীতি হচ্ছে। পঞ্চায়েতের তৈরি মাগুরাশোল বাগান থেকে অবাধে চুরি যাচ্ছে নানা গাছ। বিশেষ করে চন্দন গাছ। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে শোভাদেবী জানান, প্রায় ৬০ কোটি টাকার চন্দন কাঠ লুঠ হয়েছে। রাস্তায় মোরাম ফেলার ক্ষেত্রেও দুর্নীতির কথা জানিয়েছেন শোভাদেবী।

ওই পঞ্চায়েত সূত্রে খবর, লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার পর বুথে যাতায়াতের রাস্তা সারানোর জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে পঞ্চায়েতকে প্রায় ৬৯ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূলের ব্লক সভাপতি দিলীপ পালের অনুগামীরা পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা না করে, কোনও দরপত্র ছাড়াই মোরাম ফেলতে শুরু করেন। তৃণমূলের অন্দরে দিলীপ পালের বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজন প্রতিবাদ করলে প্রধান এবং পঞ্চায়েত সচিব সৌমিত্র রায় লিখিত ভাবে জানান এই কাজের সঙ্গে পঞ্চায়েতের সম্পর্ক নেই।

লোকসভা ভোট মেটার পরে আট হাজার গাড়ি মোরাম ফেলার হিসেব দিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার পঞ্চায়েতের কাছে ৫৪ লক্ষ টাকা দাবি করেন। স্বভাবতই টাকা দিতে রাজি হননি পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ। তখনই প্রদ্যোৎ ঘোষ ও দিলীপ পালের অনুগামী নেতাদের কোপের মুখে পড়েন প্রধান এবং সচিব। গত ২২ মে পঞ্চায়েত সচিব সৌমিত্রবাবুকে মারধর করা হয়। প্রাণভয়ে ২৫ মে থেকে ঘরছাড়া হন প্রধান শোভাদেবী। সৌমিত্রবাবুর কথায়, “অনৈতিক কাজ না করায় তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা আমাকে মারধর করে।” এরপরই তৃণমূল নেত্রীকে চিঠি লিখে বিহিত করার আবেদন জানান শোভাদেবী। তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎবাবু তাঁকে ফোনে অপমানকর কথা বলেছেন বলেও চিঠিতে জানান তিনি। পরে কলকাতায় গিয়ে মুকুলবাবুকে সব জানান ওই প্রধান।

তৃণমূল সূত্রের খবর, সমস্যা সমাধানে গত ৩০ মে মুকুলবাবু চার সদস্যের কমিটি গড়ে দেন। কমিটিতে ছিলেন তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কার্যকরী সভাপতি নির্মল ঘোষ, ঘাটালের বিধায়ক শঙ্কর দোলুই, শালবনির বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাতো ও কর্মাধ্যক্ষ কাবেরী চট্টোপাধ্যায়। ৩ জুন কমিটির সদস্যরা গড়বেতায় গিয়ে দীর্ঘ বৈঠকের পর স্থানীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দেন, এ সব চলবে না। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব মারধরের জন্য পঞ্চায়েত সচিবের কাছে ক্ষমাও চান। এরপর এলাকায় ফিরে ৪ জুন থেকে পঞ্চায়েতের কাজ শুরু করেন প্রধান শোভাদেবী। তবে মোরাম ফেলার টাকা বকেয়াই রয়েছে! শোভাদেবীর তাই আশঙ্কা, “টাকার জন্যে ফের ওরা চাপাচাপি করতে পারে।”

শোভাদেবী যাঁদের বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছেন, তৃণমূলের সেই দুই নেতাই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জেলা নেতা প্রদ্যোৎবাবুর বক্তব্য, “দুর্নীতির অভিযোগ সত্য নয়।” আর এমন ঘটনার কথা জানা নেই বলে দাবি করেছেন ব্লক সভাপতি দিলীপবাবু।

কড়সার প্রধান কবিরুলের সঙ্গে অশান্তি শুরু গাছ পাচার নিয়ে। অভিযোগ, দলীয় নেতৃত্বের একাংশের মদতে পাচার হওয়া কাঠের গাড়ি ধরে ফেলার পরই প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় ওই প্রধানকে। তার জেরেই ১৬ মে থেকে তিনি ঘরছাড়া। কবিরুলের বক্তব্য, কাঠালডিহা জঙ্গল থেকে গাছ পাচার, কাচডহর থেকে পাথর চুরি, একশো দিনের প্রকল্পে কম দিন কাজ করিয়ে বেশি দিনের বিল করার মতো নানা ঘটনায় প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। তাতেই শালবনির বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাতোর বিরাগভাজন হন। কাঠের গাড়িও বিধায়কের মদতেই পাচার হচ্ছিল বলে অভিযোগ কবিরুলের। এই শ্রীকান্তই আবার আমলাগোড়ার দুর্নীতির অভিযোগের ঘটনায় অনুসন্ধান কমিটির সদস্য। তাঁর অবশ্য দাবি, “কবিরুলের অভিযোগ ভিত্তিহীন। জানি না, উনি কেন এমন বলছেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন