জগন্নাথ ঘোড়ই।—নিজস্ব চিত্র।
জন্ম থেকেই দু’হাত নেই। উচ্চতাও অনেক কম। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সঙ্গী ছিল দারিদ্রও। তবুও জীবন যুদ্ধে হাল ছাড়েনি নন্দকুমার থানার প্রত্যন্ত বাড় বহিচবেড়িয়া গ্রামের ছেলে জগন্নাথ ঘোড়ই। বাড়ির ছোট ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন জগন্নাথের বাবামাও। তবে এই যুদ্ধে জগন্নাথ পাশে পেয়েছিল বৃদ্ধা ঠাকুমাকে। তাই পা দিয়ে লিখেই মাধ্যমিকে সফল হওয়ার আশা চোখে নিয়ে নতুন যুদ্ধে নামতে চলেছে সে।
সোমবার থেকে শুরু মাধ্যমিক পরীক্ষা। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় বসার আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সে। হাত নেই, ডান পাও দুর্বল তো কী হয়েছে, বাম পা দিয়েই লেখা, স্নান করা, খাওয়া, ছবি আঁকা, পোশাক সেলাই, ঠাকুর তৈরি, মাউথ অরগ্যান বাজানো, মোবাইল ফোন ব্যবহার সহ প্রায় সব কাজ করতে পারে জগন্নাথ। ছেলে মাধ্যমিকে বসবে, কয়েকদিন আগেও এমনটা ভাবতে পারতেন না জগন্নাথের বাবা রবীন্দ্রনাথ ঘোড়ই ও মা স্বপ্না দেবী। রবীন্দ্রনাথবাবু দিনমজুর। নিজেদের জমিজমাও নেই। অল্প আয়ে কোনও মতে সংসার চলে। জগন্নাথের বাবা রবীন্দ্রনাথবাবুও বলেন, “আমাদের পরিবার খুব গরিব। তাই জগন্নাথকে নিয়ে চিন্তা ছিলই। ওর চেষ্টা দেখে আমাদের অনেক কষ্ট দূর হয়েছে।
জগন্নাথের বড় দাদা মোহন জানান, জন্ম থেকেই ভাইয়ের দু’হাত নেই। ডান-পা সরু, দুর্বল। ভাল করে দাঁড়াতেই পারত না। তাই ওকে নিয়ে আমাদের সকলের খুব চিন্তা ছিল। বাবা এক সময় জগন্নাথকে সার্কাসের দলে দেওয়ার মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু ঠাকুমা ওকে কাছ ছাড়া করতে রাজি ছিল না। অনেক চেষ্টার পরে প্রায় ৫-৬ বছর বয়সে জগন্নাথ একটু করে দাঁড়াতে ও হাঁটাচলা করতে শেখে। আর পা দিয়ে শ্লেটে লিখতে চেষ্টা করতে থাকে। আমরা প্রথমে বুঝতেই পারিনি জগন্নাথ পা দিয়ে লিখতে পারবে। বছর দু’য়েক পর জগন্নাথকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করা হয়। তারপরে বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নিমতৌড়ির তমলুক উন্নয়ন সমিতি পরিচালিত প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ বিদ্যালয়েই পড়াশোনা করে সে। প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর নন্দকুমারের বেতকল্লা মিলনী বিদ্যানিকেতন হাইস্কুলে পড়া জগন্নাথ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।
নিমতৌড়ি তমলুক উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক যোগেশ সামন্ত বলেন, “যেদিন ছোট্ট জগ্ননাথ এসেছিল, প্রথমে আমরাও ওকে ঠিক বুঝতে পারিনি। পরে জগন্নাথের মনের জোর দেখে আমরা চমকে গিয়েছিলাম। শুধুমাত্র এক পা দিয়েই অসম্ভবকে জয় করা যায়। জগন্নাথ আমাদের কাছে সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আশা করছি মাধ্যমিকেও ও ভাল ফল করবে।” বাড়ি থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ব্যবত্তারহাট আদর্শ হাইস্কুলের জগন্নাথের পরীক্ষা কেন্দ্র পড়েছে। জগন্নাথের কথায়, “মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারব ভেবে খুব আনন্দ হচ্ছে। আরও লেখাপড়া করতে চাই আমি। যে ভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে লেখাপড়া শিখছি, ভবিষ্যতে নিজেও শিক্ষক হয়ে সে ভাবে অন্যদের লেখাপড়া শেখাতে চাই।”