বাজার আছে, তবু কমছে বাদাম চাষ

বছর দশেক আগে কয়েক বিঘে জমিতে পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয়েছিল বাদাম চাষ। ক্রমে অর্থকরি, বিকল্প ফসলের চাষ ছড়িয়ে পড়ে এগরা মহকুমার দশ হাজার হেক্টর জমিতে। বিঘা প্রতি লাভ ছিল প্রায় কুড়ি হাজার টাকা! পাঁচ বছর আগেই বাদাম চাষ হয়, এমন কৃষিজমির পরিমাণ কমে হয় অর্ধেক, পাঁচ হাজার হেক্টর। আর এখন? মহকুমা কৃষি দফতরের কর্তাদের আশঙ্কা, চলতি মরসুমে বাদাম চাষ হওয়া জমির পরিমাণ দু’তিন হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়াবে।

Advertisement

কৌশিক মিশ্র

এগরা শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:২৩
Share:

চলছে বাদাম ঝাড়াই। ফাইল চিত্র।

বছর দশেক আগে কয়েক বিঘে জমিতে পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয়েছিল বাদাম চাষ। ক্রমে অর্থকরি, বিকল্প ফসলের চাষ ছড়িয়ে পড়ে এগরা মহকুমার দশ হাজার হেক্টর জমিতে। বিঘা প্রতি লাভ ছিল প্রায় কুড়ি হাজার টাকা!

Advertisement

পাঁচ বছর আগেই বাদাম চাষ হয়, এমন কৃষিজমির পরিমাণ কমে হয় অর্ধেক, পাঁচ হাজার হেক্টর। আর এখন? মহকুমা কৃষি দফতরের কর্তাদের আশঙ্কা, চলতি মরসুমে বাদাম চাষ হওয়া জমির পরিমাণ দু’তিন হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়াবে।

বাদাম চাষের উপযুক্ত দোঁআশ মাটি-পরিবেশ কিংবা অভিজ্ঞতা রয়েছে স্থানীয় কৃষিজাবীদের। তা সত্বেও এমন অর্থকরি ফসলের চাষে ক্রমশ আগ্রহ হারাচ্ছেন তাঁরা। কেন?

Advertisement

কৃষিজীবীদের বক্তব্য, দীর্ঘ দিনের দাবি সত্ত্বেও বাদাম মজুত রাখার কোনও উপযুক্ত গুদাম তৈরি হয়নি। উৎপন্ন বাদাম বাজারজাত করা কিংবা বিপণনেও উদ্যোগী হয়নি পুরসভা কিংবা প্রশাসন। বাদাম প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের মাধ্যমে বাদাম তেল বা নানা রকমের খাদ্য দ্রব্য তৈরির কোনও পরিকাঠামোও গড়ে ওঠেনি।

স্থানীয় কৃষিজীবী কালীপদ মান্না, বাদল বেরা-রা প্রশাসনিক উদাসীনতায় হতাশ। ক্ষোভের সঙ্গে তাঁরা বলছেন, “চলতি বছরে আর বাদাম চাষ করব না। ফলন ভালই হয়, কিন্তু খাটনির পর দাম পাই কই?”

একুশ বছর হল পুরসভায় উত্তীর্ণ হয়েছে এগরা। তবে এখনও এলাকার অর্থনীতি থমকে প্রথাগত কৃষি-নির্ভর চাষেই। জনসংখ্যার সত্তর শতাংশেরও বেশি এখনও কৃষিজীবী। আর পাঁচটা এলাকার মতো এগরার অধিকাংশ এলাকায় ধানই প্রধান কৃষিজাত ফসল। জমিতে দশকের পর দশক ধরে প্রথাগত পদ্ধতিতে ধান চাষের জেরে কমছে জমির উর্বরতা। এই অবস্থায় চাষের মাধ্যমে এগরার অর্থনীতির হাল ফেরাতে সেরা বাজি হতে পারত বাদাম চাষ। কিন্তু, উদ্যোগের অভাব ও প্রশাসনিক গড়িমসিতে সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্টির পথে।

এগরা মহকুমা কৃষি আধিকারিক (প্রশাসন) কল্লোল পালের মত, ফি-বছর ধান চাষ না করে বাদাম আর ধান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করলে দু’টিরই ফলন বাড়ে। মাটির গুণও বাড়ে। বাড়তি রোজগার হয়। তা হলে কৃষি দফতরের তরফে শিবির করে চাষীদের সেই পাঠ দেওয়া হচ্ছে না কেন? কেনই বা উৎপন্ন ফসল বিপণন বা প্রক্রিয়াকরণের ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা করছে না কৃষি দফতর? প্রশ্নগুলি যে অমূলক নয়, তা মানছেন কল্লোলবাবুও। তিনি বলেন, “বিষয়গুলি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উৎপন্ন ফসলের বিপণন করার ব্যাপারেও উদ্যোগী হব।”

কৃষিজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিঘে প্রতি ১২ থেকে ১৪ কুইন্ট্যাল বাদাম (খোসা-সহ) ফলে। এক কিলোগ্রাম খোসা বাদাম থেকে সাতশো গ্রাম বাদামের দানা মেলে। বিঘে প্রতি খরচ ৩০-৩৫ হাজার। ফেব্রুয়ারির শুরুতে বাদামের বীজ বোনা হয়। মাস পাঁচেক পর বর্ষার শুরুতে ফসল ওঠে। বাদাম চাষে সব খরচ-খরচা বাদ দিয়ে বিঘে প্রতি লাভ হত পনেরো হাজার। সম্প্রতি সেই হিসেব উল্টে গিয়েছে। গত বছর বিঘে প্রতি ক্ষতি হয়েছে কারও পাঁচ হাজার কারও দশ হাজার! কেন?

গত মরশুমে বাদাম গাছের গোড়ায় জল দাঁড়িয়ে গাছ পচে গিয়ে, কোথাওবা বাদামের রং নষ্ট হয়ে গিয়ে ওই বিপুল ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষিজীবীরা। এরপর বাদাম চাষীরা ক্ষতিপূরণ চেয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন, নানা আন্দোলনও করেছেন। কিন্তু, সামান্য কিছু কৃষি সরঞ্জাম, কৃষিঋণের সুদে ছাড় বই আর কিছুই মেলেনি বলে অভিযোগ তাঁদের। এই পরিস্থিতিতে হতাশায় বাদাম চাষ থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন স্থানীয়েরা।

এলাকার চাষিরা বলছেন, এলাকায় যদি বাদাম থেকে তেল বা অন্য নানা স্বাদু খাদ্য সামগ্রী তৈরির মতো কোনও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প তৈরি করা হত, তা হলে বাদাম চাষে বাড়তি আগ্রহ পেতেন তাঁরা। কেউ কেউ বলছেন, এলাকায় বাজার না থাকায় লাভের কিছুটা (কিলোগ্রাম প্রতি পাঁচ টাকারও বেশি) মধ্যস্বস্ত্বভোগীদের হাতে চলে যায়। মহকুমা প্রশাসনের উদ্যোগে এলাকায় বাজার তৈরি হলে বিপণনের পাশাপাশি সেই সম্ভাবনা ঠেকানো যেত।

মহকুমাশাসক অসীমকুমার বিশ্বাস বলছেন, “এলাকায় উৎপাদিত বাদাম থেকে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের মাধ্যমে নতুন নানা জিনিস তৈরি করা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করব।” এখন দেখার, প্রশাসনের তৎপরতায় অর্থকরি, বিকল্প ফসল বাদাম এগরার কৃষি-অর্থনীতিতে কতটা বদল আনতে পারে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন