বিজ্ঞান নিয়ে অনেক দূর পড়াশোনা করার ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু স্বপ্নপূরণের পথে দারিদ্র্যই কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না তো? মাধ্যমিকে ভাল ফল করেও তাই দুর্ভাবনা কাটছে না অয়ন দাস, বুদ্ধদেব তোরইদের।
অয়ন দাস এ বার মাধ্যমিকে ৬১৮ নম্বর পেয়েছে। মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের এই ছাত্রের বাড়ি শহরের হাতারমাঠ এলাকায়। বাবা তরুণকান্তি দাস সেলাইয়ের কাজ করেন। মা নিৎপলাদেবী গৃহবধূ। দুই ছেলের মধ্যে অয়ন ছোট। বড় ছেলে অঙ্কন এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে অয়নের। বাবার মাসে আয় বড়জোর আড়াই-তিন হাজার টাকা। পুজোর সময় আয় একটু বেশি হয়। তরুণকান্তিবাবু বলছিলেন, “জানি না ছেলের স্বপ্নপূরণ করতে পারব কি না। শিক্ষকেরা সব রকম সহযোগিতা করেছেন। না হলে ও এই ফল করতে পারত না।” অবসরে গল্পের বই পড়তে ভালবাসে অয়ন। টিভিতে ক্রিকেটও দেখে। সে সব থেকে বেশি পেয়েছে ভৌতবিজ্ঞানে, ৯৪। মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক দীপঙ্কর সন্নিগ্রাহী বলেন, “ও খুব ভাল ছাত্র। ইচ্ছে আর মনের জোর থাকলে দারিদ্র্যতা কখনও স্বপ্নপূরণে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।”
বুদ্ধদেব তোরই মাধ্যমিকে ৬০৯ নম্বর পেয়েছে। মেদিনীপুর টাউন স্কুলের এই ছাত্র থাকে পাটনাবাজারে। বুদ্ধদেবরা দুই ভাই, এক দিদি। টেনেটুনেই সংসার চলে। বাবা উজ্জ্বলবাবু বেসরকারি বাসের চালক। মা পূর্ণিমাদেবী গৃহবধূ। মাসে আয় মেরেকেটে পাঁচ হাজার টাকা। ফলে, উচ্চশিক্ষা নিয়ে দুর্ভাবনার মেঘটা রয়েই যাচ্ছে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে বুদ্ধদেব চায় ডাক্তার হতে। মা পূর্ণিমাদেবী বলছিলেন, “দেখা যাক কতদূর কী হয়!” বুদ্ধদেব সবথেকে বেশি নম্বর পেয়েছে জীবনবিজ্ঞানে, ৯৮।
অনেক দূর পড়তে চায় গণেশ ঘোড়ইও। মেদিনীপুর টাউন স্কুলের এই ছাত্রের স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। বাড়ি মেদিনীপুর শহরের মহাতাবপুরে। বাবা সুকুমারবাবু সবজি বিক্রেতা। শহরের রাজাবাজারে সবজি বিক্রি করেন। মাসে রোজগার বড়জোর আড়াই-তিন হাজার টাকা। মা বন্দনাদেবী গৃহবধূ। সুকুমারবাবুর এক ছেলে, এক মেয়ে। গণেশ ছোট। তিনি বলছিলেন, “টেনেটুনে কোনওমতে সংসার চালাই।” এ বার মাধ্যমিকে গণেশের প্রাপ্ত নম্বর ৫৬০। সব থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে সে জীবনবিজ্ঞানে, একেবারে একশোয় একশো। কৃতী এই ছাত্রের কথায়, “এটা আমার প্রিয় বিষয়।” টাউন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিবেকানন্দ চক্রবর্তী বলেন, “এরা যদি একটু আর্থিক সাহায্য পায়, তাহলে আরও বেশি বিকাশ ঘটাতে পারবে। আমরা যতটা পারি সহযোগিতা করি।”
সায়ন্তী ঘোষ এ বার মাধ্যমিকে ৫৮৭ নম্বর পেয়েছে। কেশপুরের তোড়িয়া হাইস্কুলের ছাত্রী সে। দারিদ্র্যের পরিবারেই বড় হয়ে ওঠা। বাবা অদ্বৈত ঘোষ দিনমজুর। সামান্য জমি রয়েছে। সায়ন্তীরা এক ভাই, এক বোন। চোখে শিক্ষিকার হওয়ার স্বপ্ন। তবে স্বপ্নপূরণ হবে তো? সংশয়ে রয়েছে পরিবার। এই মেধাবী ছাত্রী নিজেও এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। বিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা করতে চায়। তোড়িয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক উৎপল গুড়ে বলেন, “ও মেধাবী ছাত্রী। স্কুলের শিক্ষকেরা সব রকম ভাবে ওকে সহযোগিতা করেন। আগামী দিনেও করবেন। আমাদের তরফে ওকে যতটা সাহায্য করা সম্ভব, আমরা ততটা করব। সায়ন্তীর পরিবারের আর্থিক সমস্যার কথা আমরা জানি। ও পঞ্চম শ্রেণী থেকেই আমাদের স্কুলে পড়ছে।” “সকলেরই উচিত, কৃতীদের পাশে এসে দাঁড়ানো। না- হলে তো তারা হারিয়ে যাবে”, বলছিলেন উৎপলবাবু।
কৃতীদের বেশিরভাগই বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। পরিবারে অনটন রয়েছে। সেই কাঁটা সরিয়েই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে অবিচল অয়ন-বুদ্ধদেব-গণেশরা।
—নিজস্ব চিত্র।