বটতলাচক থেকে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। অটোয় ওই রুটের ভাড়া আট টাকা। কিন্তু ওই সামান্য পথেই রিকশায় উঠলে খসবে ২০-২৫ টাকা।
বাসস্ট্যান্ড থেকে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় রুটেও অটো ভাড়া ৮ টাকা, আর রিকশা ভাড়া ৪০-৫০ টাকা।
এক সময় পুরসভা উদ্যোগী শহরে রিকশা ভাড়া ঠিক করে দিয়েছিল। অনেক শহরেই এ ভাবে রিকশা ভাড়া বেঁধে দেওয়া হয়। রিকশা স্ট্যান্ডগুলোয় নির্ধারিত ভাড়ার সাইনবোর্ডও লাগানো হয়েছিল। অবশ্য এখন শহরে রিকশা ভাড়ার কোনও তালিকা নেই। সেই সব সাইনবোর্ডগুলোও উধাও! সুযোগ বুঝে অনেকে তিন- চারগুন ভাড়াও হাঁকেন। মাঝে-মধ্যে যাত্রীদের সঙ্গে রিকশা চালকদের বচসা বাঁধে। একাংশ রিকশা চালক যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলেও অভিযোগ। সবমিলিয়ে, মেদিনীপুর আছে যেন সেই মেদিনীপুরেই! শহরে রিকশার দাপাদাপি যে রয়েছে তা মানছেন পুর- কর্তৃপক্ষও। মেদিনীপুর পুরসভার পুরপ্রধান প্রণব বসু বলেন, “শহরে রিকশা ভাড়া নির্ধারিত নেই। তাই অনেকে বাড়তি ভাড়া নেয়। কেউ কেউ তিন- চারগুন বেশি ভাড়া নেয় বলেও শুনেছি। এটা একটা সমস্যা।” কেন ভাড়া বেঁধে দেওয়া হচ্ছে না? প্রণববাবুর জবাব, “এক সময় শহরে রিকশা ভাড়া বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। নতুন করে ফের ভাড়া বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। তবে এটা কতটা মান্যতা পাবে সেটা নিয়ে সংশয় রয়েছে।” পাশাপাশি তাঁর আশ্বাস, “এই সমস্যা নিয়ে আমরাও চিন্তিত। সমাধানের একটা উপায় খোঁজার চেষ্টা হবে।”
আড়ে-বহরে দ্রুত বাড়ছে মেদিনীপুর শহর। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শহরের জনসংখ্যাও। এখনই শহরের জনসংখ্যা প্রায় পৌনে দু’লক্ষ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সদর শহর মেদিনীপুর। এই শহরে রয়েছে কালেক্টরেট, জেলা পরিষদ, বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা আদালত, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, প্যারা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজ হাসপতাল। শহরের নানা প্রান্তে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ফলে, নানা কাজে প্রতিদিন শহরে হাজার হাজার মানুষ আসেন। ফলে অল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য বহু লোক রিকশার উপর নির্ভর করেন।
পুরসভার এক সূত্রে খবর, লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশার সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এ ছাড়া লাইসেন্সবিহীনর রিকশার সংখ্যাটা প্রায় দেড় হাজারের কাছাকাছি। মেদিনীপুরের উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাস অবশ্য বলেন, “শহরে প্রায় তিন হাজার লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশা আছে, এটা জানা। তবে লাইসেন্সবিহীন রিকশার সংখ্যা কত, তার ঠিকঠাক হিসেব আমাদের কাছে নেই। তবে শহরে লাইসেন্সবিহীন রিকশা আছে এটা ঠিক।” রিকশা চালকেরা বাড়তি ভাড়া হাঁকায় অনেক সময়ই যাত্রীদের সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। কারন, শহরের এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যেতে হলে যে রিকশাই ভরসা। অটো তো চলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাস্তায়। ছোট রাস্তা কিংবা অলিগলিতে নয়। কলেজ ছাত্রী সুস্মিতা দাসের কথায়, “রিকশা চালকদের সঙ্গে দরাদরি করেও তো তেমন লাভ হয় না। সেই বাড়তি ভাড়াই দিতে হয়।” বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুদীপ চৌধুরীর কথায়, “রাতের শহরে অনেক সময় রিকশাও মেলে না। সুযোগ বুঝে চালকেরা যে যা পারেন, ভাড়া নেয়।” রিকশা চালকদের অবশ্য দাবি, মুষ্টিমেয় কয়েকজনই যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া হাঁকেন। সকলে নয়। শম্ভু বেহেরা, মানস দাস প্রমুখ রিকশা চালকের কথায়, “একজন যাত্রী হলে যে ভাড়া নেওয়া হবে, দু’তিন জন যাত্রী হলে ভাড়া তো একটু বেশি দিতেই হবে। অনেক সময় ভাড়া নিয়ে দরাদরি করতে গিয়ে যাত্রীরাই গোলমাল করেন। বচসা বাধান।” তাঁদের দাবি, “পুরসভা থেকে রিকশা ভাড়া বেঁধে দেওয়া হলে আপত্তি নেই। তবে নির্ধারিত ভাড়া বাজারদরের সঙ্গে মানানসই হতে হবে।”
কী বলছে শ্রমিক সংগঠনগুলো? তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি’র নেতা শশধর পলমল বলেন, “রিকশা ভাড়া বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগটা পুরসভাকেই নিতে হবে। শহরে রিকশা ভাড়া বেঁধে দেওয়াই উচিত।” তাঁর কথায়, “বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রিকশা ভাড়া বেঁধে দেওয়া হোক। এই ভাবে ভাড়া বেঁধে দেওয়া হলে যদি কোনও চালক তা না- মানেন, তাহলে আমরাও তার পাশে থাকব না।” সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটুর নেতা সারদা চক্রবর্তী বলেন, “পুরসভাই রিকশা ভাড়া বেঁধে দেয়নি। ফলে, একাংশ চালক ইচ্ছে মতো ভাড়া হাঁকেন।” তাঁর কথায়, “বাজারদরের সঙ্গে মানানসই রেখে শহরে রিকশা ভাড়া নির্ধারিত করা হোক। পাশাপাশি যে সব অটো রুট ভেঙে চলাচল করে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কারণ, রুট ভেঙে অটো চলাচলের ফলে রিকশা চালকদের অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন।”
পরিস্থিতি দেখে মেদিনীপুর শহরে ব্যাটারি চালিত রিকশা চালু করারও উদ্যোগ নিতে চলেছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। পুরসভার এক সূত্রে খবর, আগামী বোর্ড মিটিংয়ে এ নিয়ে আলোচনা এক পুর-কর্তার কথায়, “রিকশা ভাড়া নিয়ে সমস্যার কথা আমাদের অজানা নয়। অনেকে বেশি ভাড়া হাঁকেন। সমস্যার সবটাই জানা আছে। তবে যা হবে পুরসভায় আলোচনার মাধ্যমেই হবে। খুব শীঘ্রই ব্যাটারি চালিত রিকশাও চালু হতে পারে।”
শহরবাসীর হয়রানি এড়াতে কী পদক্ষেপ করে পুরসভা, সেটাই এখন দেখার!