ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে রাজ্য সরকার। আর তার জেরে আলু এখন নিলামে উঠছে বলে অভিযোগ।
রাজ্যের খোলা বাজারে পাইকারি আলুর দাম বর্তমানে কেজি প্রতি ১৫-১৬ টাকা। খুচরো বিক্রেতাদের কাছে তা পৌঁছচ্ছে ২০-২২ টাকা কেজি দরে। ব্যবসায়ীরাই জানাচ্ছেন, ওই আলু ওড়িশা নিয়ে যেতে পারলে কেজি প্রতি দাম মিলবে ২৫-২৬ টাকা। এই মুনাফার লোভেই আলু নিলামে উঠছে বলে অভিযোগ। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজ্যকে ১৩ টাকা কেজি দরে ২০০ মেট্রিক টন আলু দিলে তবেই দিনে ১১০০ মেট্রিক টন আলু বাইরের রাজ্যে পাঠাতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। সকলেই চাইছেন আলু ভিন্ রাজ্যে রফতানি করতে। তাই কোন ব্যবসায়ীর লরি বাইরের রাজ্যে যাওয়ার ছাড়পত্র পাবে, তা ঠিক করতে নিলাম হচ্ছে বলে অভিযোগ।
যদিও আলু নিলামে ওঠার অভিযোগ অস্বীকার করেছে প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি। বাইরের রাজ্যে আলু পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই সংগঠনের হাতে। সমিতির সম্পাদক বরেন মণ্ডলের দাবি, “নিলামের কথা ঠিক নয়। তবে কার আলু বাইরে যাবে তা ঠিক করতে লটারি হচ্ছে ।” সমিতির চন্দ্রকোনা রোড শাখার সম্পাদক অসিত পাল অবশ্য মানছেন, “প্রথমে কিছু শাখা বুঝতে না পেরে নিলাম করে ফেলেছিল। সে কথা জানার পরেই সমিতির তরফে সাফ বলা হয়েছে, নিলাম করা যাবে না। লটারি করতে হবে।”
আলু ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা যা-ই বলুন না কেন, নিলাম যে এখনও হচ্ছে তা স্বীকার করে নিয়েছেন বহু ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, সমিতির চন্দ্রকোনা টাউন শাখায় বুধবার ৮১ হাজার টাকা ও বৃহস্পতিবার ১ লক্ষ ১১ হাজার টাকায় এক একটি আলুর গাড়ি নিলামে উঠেছে। এই এক গাড়ি (১৬ মেট্রিক টন) আলু রাজ্যের খোলাবাজারে বিক্রি করলে ২ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা মিলত। অর্থাৎ নিলামের দাম ধরলে প্রতি গাড়ি আলুর দাম দাঁড়াচ্ছে ৩ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা। তা-ও নিলামের চড়া টাকা দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, এক গাড়ি আলু ওড়িশা নিয়ে বিক্রি করলে মিলবে ৪ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা। গাড়ি ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ ২৫-৩০ হাজার টাকা বাদ দিলেও নিশ্চিত লাভ থাকবে ২৫ হাজার টাকার বেশি। অর্থাৎ ৫ গাড়ি আলু পাঠালে দিনে ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকার বেশি লাভ।
জানা গিয়েছে, এ বার কুইন্টাল প্রতি ৭০০-৯৫০ টাকা দরে হিমঘরে আলু রেখেছিলেন ব্যসায়ীরা। হিমঘরে আলু রাখার খরচ কুইন্টাল প্রতি ১৪০ টাকা। তা বাদ দিলে কুইন্টাল প্রতি আলুর দাম ১,১০০ টাকার বেশি হয় না। আলু ওড়িশা নিয়ে গেলে কুইন্টাল প্রতি দাম মেলে ২৫০০-২৬০০ টাকা। তাই কাদের আলু ভিন্ রাজ্যে যাবে, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে লটারির সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীরাই মানতে চাননি বলে খবর। তাঁরা নিলাম চেয়েছিলেন। কিন্তু নিলামের কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় চাপে পড়ে যায় প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি। তাই তারা নিলামের কথা অস্বীকার করছে। আলু ব্যবসায়ীদেরই একাংশ জানিয়েছেন, বিষয়টি ধামাচাপা দিতে এখন সমিতির অফিসের পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের বাড়িতেই হচ্ছে নিলাম। মোবাইলে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোনদিন কার বাড়িতে নিলাম হবে। সেই মতো হাজির হয়ে যাচ্ছেন আলু ব্যবসায়ীরা।
আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাজ্যে দিনে ২০০ মেট্রিক টন আলু ১৩ টাকা কেজি দরে দিলে তবেই রাজ্যের বাইরে পাঠানো যাবে ১১০০ মেট্রিক টন আলু। কোন ব্যবসায়ীর আলু রাজ্যের বাজারে যাবে আর কোন ব্যবসায়ীর আলু ভিন্ রাজ্যে পাঠানো হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতিকে। সিদ্ধান্ত মতো পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে ৪৫০ মেট্রিক টন আলু দিনে ভিন্ রাজ্যে যাওয়ার কথা। জেলায় সমিতির ১৬টি শাখা রয়েছে। চন্দ্রকোনা রোড, আমলাগোড়া, চন্দ্রকোনা টাউন প্রভৃতি। প্রতিটি শাখায় ৫০-১০০ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। এঁদের মধ্যে কার কতটা আলু বাইরে যাবে তা ঠিক করতে প্রথমে লটারির সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে।
সমিতি সূত্রের খবর, ঠিক হয়েছিল লটারিতে যে ব্যবসায়ীর নাম উঠবে তিনি ২৭ হাজার টাকা সমিতিকে দেবেন। তার মধ্যে ২৫ হাজার টাকা রাখা থাকবে ক্ষতিপূরণ বাবদ। ২ হাজার টাকা থাকবে সমিতির খরচ বাবদ। কারণ, রাজ্য সরকারের সঙ্গে বৈঠক, রাস্তায় আলুর গাড়ি ধরলে সেই সমস্যা মেটানো, এ সবের জন্য যাতায়াত, খাওয়া-সহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে। সমিতি সূত্রের খবর, লটারির জন্য টাকা দিতে হবে জেনে ব্যবসায়ীদের একাংশই প্রস্তাব দেন, “২৭ হাজার নয়, ৪৭ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি। যার ক্ষমতা রয়েছে সে নিলামে নিক। লটারি চলবে না।” এরপর একাংশ ব্যবসায়ীর চাপে নিলাম চালু হয় বলে অভিযোগ।
প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেই ৫৬ লক্ষ মেট্রিক টন আলু হিমঘরে রাখা হয়েছিল। এখনও ২৫ লক্ষ মেট্রিক টন আলু হিমঘরে রয়েছে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে হিমঘর খালি করে দেওয়ার কথা। সেই হিসাবে দিনে অন্তত ১৪ হাজার মেট্রিক টন আলু বাইরে পাঠাতে হবে। তাই বেশি ও নিশ্চিত মুনাফার লোভে নিলাম হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এক ব্যবসায়ীর কথায়, “গাড়ি পিছু ৫০-৬০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়তো হচ্ছে, কিন্তু লাভও ভাল পেয়েছি।”