লক্ষ্মণ-হীন ভোটে নন্দীগ্রাম বাম শূন্য

চণ্ডীপুর থেকে নন্দীগ্রাম যাওয়ার রাস্তায় কুলবাড়ির কাছে শেষবার চোখে পড়েছিল লাল পতাকা। চণ্ডীপুর ব্লকের শেষ সীমানায় কুলবাড়ি এখনও সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি বলেই পরিচিত। কিন্তু নন্দীগ্রামের গোটা তল্লাটে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের উপস্থিতি জানান দেয়, এমন কিছু আর নজরে এল না। পতাকা নেই, নেই ক্যাম্প অফিস। সোমবার তমলুক কেন্দ্রে লোকসভা ভোটের দিন নন্দীগ্রামের অধিকাংশ বুথে সিপিএমের পোলিং এজেন্টও ছিল না। যদিও কিছু জায়গায় কংগ্রেস, বিজেপির এজেন্ট ছিল। এজেন্ট ছিল নির্দল প্রার্থী কালীশঙ্কর জানারও।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল ও অমিত করমহাপাত্র

নন্দীগ্রাম ও হলদিয়া শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৪ ০২:০৪
Share:

মহিষাদলের ডালিম্বচকে বুথ ঘুরে দেখছেন শুভেন্দু অধিকারী। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

চণ্ডীপুর থেকে নন্দীগ্রাম যাওয়ার রাস্তায় কুলবাড়ির কাছে শেষবার চোখে পড়েছিল লাল পতাকা। চণ্ডীপুর ব্লকের শেষ সীমানায় কুলবাড়ি এখনও সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি বলেই পরিচিত। কিন্তু নন্দীগ্রামের গোটা তল্লাটে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের উপস্থিতি জানান দেয়, এমন কিছু আর নজরে এল না। পতাকা নেই, নেই ক্যাম্প অফিস। সোমবার তমলুক কেন্দ্রে লোকসভা ভোটের দিন নন্দীগ্রামের অধিকাংশ বুথে সিপিএমের পোলিং এজেন্টও ছিল না। যদিও কিছু জায়গায় কংগ্রেস, বিজেপির এজেন্ট ছিল। এজেন্ট ছিল নির্দল প্রার্থী কালীশঙ্কর জানারও।

Advertisement

নজরে পড়ার মতো সিপিএমের এই অনুপস্থিতির বাইরে কোনও গোলমাল অবশ্য পরিবর্তনের আঁতুড়ঘরে নন্দীগ্রামে এ দিন হয়নি। গোটা তমলুক কেন্দ্রেই ভোট-পর্ব মিটেছে নির্বিঘ্নে। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক অন্তরা আচার্য বলেন, “বড় কোনও গোলামাল ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছে। বিকেল ৬টা পর্যন্ত তমলুকে ৮৬.২৬ শতাংশ ভোট পড়েছে।” নির্দিষ্ট সময়ের পরেও কিছু বুথে লাইন ছিল।

দীর্ঘ ২৬ বছর পর হলদিয়ায় এ বার লক্ষ্মণ-হীন ভোট। ভোটের দিন ভোট পরিচালনার জন্য লক্ষ্মণবাবু কোনও নির্দেশ দেননি জানিয়ে তমালিকা পণ্ডা শেঠ বলেন, “দু’জনের রাস্তা পৃথক, তাই এসব নিয়ে তেমন কথা হয় না।” তমালিকাদেবীর অভিযোগ, এই প্রথম হলদিয়া বিধানসভা এলাকায় বুথ দখলের ঘটনা ঘটল। যা বাম আমলে কোনও দিন হয়নি। গোটা বিধানসভা এলাকার ৩৫টি বুথে সিপিএম পোলিং এজেন্ট বসাতে পারেনি। হুমকি দেখিয়ে, মারধর করে, বাড়িতে গিয়ে সন্ত্রাস তৈরি করে এজেন্টদের তুলে দেওয়া হয়েছে। হলদিয়া পুর এলাকায় তৃণমূলের বেশি সন্ত্রাস নিয়ে তমালিকাদেবী অভিযোগ করেন, “গত পুরভোটেও ভোটাররা বামপন্থী আদর্শে অনড় ছিলেন। এ বারও রয়েছেন। তা ভেঙে ফেলতে সন্ত্রাস করা হয়েছে। তাই ভাল ফলের ব্যাপারে খুব আশাবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে আশঙ্কা রয়েছে।”

Advertisement

নন্দীগ্রামের কেন্দেমারি এলাকায়। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

বড় কোনও গোলমাল না হলেও নন্দীগ্রামে ভোটের ছবিটা কিন্তু পুরোদস্তুর স্বচ্ছ ও অবাধ ছিল না। সকাল সাড়ে ৯ টা নাগাদ নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের সামসাবাদের কুলসুমিয়া আত্যয়িক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, দু’টি বুথে ভোট হচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাহারায়। বুথের ২০ ফুট দূরে জটলা। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সামনেই অবাধে বুথে ঢুকছেন-বেরোচ্ছেন তৃণমূল কর্মীরা। ওই বিদ্যালয়ের ১৯২ নম্বর বুথে সফিউল আলম নামে তৃণমূলের একজন পোলিং এজেন্ট বসে থাকলেও শেখ আফিজুল হক নামে আর একজন নিজেকে পোলিং এজেন্ট পরিচয় দিয়ে বুথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

কয়েক কিলোমিটার দূরে গোকুলনগরের পারুলবাড়ি বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথের সামনেও তৃণমূল সমর্থকদের জটলা নজরে পড়ল। সংবাদমাধ্যমের লোক দেখে দূরে সরে গেলেন তাঁরা। বুথের পাহারায় ছিলেন দুই সশস্ত্র পুলিশকর্মী। বুথের ভিতরে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের একজন করে এজেন্ট থাকলেও বুথের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থানীয় নির্দল পঞ্চায়েত সদস্য তুহিন জানা। নিজেকে তৃণমূলের পোলিং এজেন্ট পরিচয় দেওয়া তুহিনবাবু সেখানে জটলা করে থাকা তৃণমূল কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।

সিপিএমের উপস্থিতি নজরে না এলেও জমিরক্ষা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র গোকুলনগরের গোবিন্দজিউ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে যাওয়ার পথে অধিকারীপাড়ায় কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর ছবি-সহ বিজেপির পতাকা, ব্যানার চোখে পড়ল। চার জন সিআরপি জওয়ান ছিলেন ওই বুথের নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে। দুটি বুথের একটিতে তৃণমূলের পোলিং এজেন্ট ছিলেন জমি আন্দোলনের নেতা স্বদেশ দাস অধিকারী। আর দু’টি বুথেই তৃণমূলের পাশাপাশি ছিল বিজেপির এজেন্টও। জমিরক্ষা আন্দোলনের আর এক প্রাণকেন্দ্র সোনাচূড়া হাইস্কুলের বুথে গিয়ে দেখা যায় প্রবেশপথে দুই পুলিশকর্মীর সামনেই বেঞ্চে বসে রয়েছেন তৃণমূল কর্মী অশ্বিনী পাত্র। বুথে ভোটারের কোনও ভিড় নেই। অশ্বিনীবাবু বললেন, “এখানে শান্তিতে ভোট হচ্ছে।” একই কথা শোনা গেল প্রিসাইডিং অফিসার সীতেন্দু দাস অধিকারীর গলায়।

বেলা সাড়ে বারোটা। নন্দীগ্রামের কেন্দেমারিতে হোসেনপুর শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে এসে দেখা গেল বুথের পাশেই একদল কর্মী-সমর্থক নিয়ে গাছতলায় দাঁড়িয়ে স্থানীয় তৃণমূল নেতা শেখ সাহাউদ্দিন। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি দেখেই সকলে শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দাঁড়িয়ে পড়লেন ভোটের লাইনে। প্রিসাইডিং অফিসার সত্যব্রত দত্ত জানালেন, ১১৮৯ জন ভোটারের মধ্যে ৮৫৮ জনই ভোট দিয়ে ফেলেছেন। নন্দীগ্রাম ছাড়াও তমলুক, ময়না, নন্দকুমারে ভোটপর্ব মিটেছে শান্তিতে।

আপাত এই শান্তির পিছনে নীরব সন্ত্রাস ছিল বলে বামেদের অভিযোগ। আগে থেকেই হুমকি, হুঁশিয়ারির জেরে বাম কর্মী-সমর্থকেরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনেককেই বুথের দিকে পা বাড়াতে দেওয়া হয়নি। সিপিএম প্রার্থী ইব্রাহিম আলির বক্তব্য, “নন্দীগ্রাম-২ ব্লকের বেশিরভাগ এলাকায় ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু সকাল থেকেই তৃণমূলের লোকজন নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের অধিকাংশ বুথের দখল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে। প্রশাসনকে অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও সাহায্য পাওয়া যায়নি।” অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূল প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “জয় নিশ্চিত। সিপিএমের হাতে এখনও নন্দীগ্রামের রক্ত লেগে রয়েছে।” বাম প্রার্থীর তোলা অভিযোগ প্রসঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলা শাসক (নির্বাচন) অজয় পালের বক্তব্য, “সিপিএমের তরফে যে সব এলাকা নিয়ে অভিযোগ এসেছিল সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন