শিল্পশহরে বিষ বাতাসে বিপন্ন প্রাণ

দূষণে জেরবার শিল্পশহর! বেলা তখন ১১টা। কাজে বেরিয়েছিলেন অশোকবাবু। ধুলোর দাপটে বাড়ি থেকে বেরনোর কিছুক্ষণ পরেই চোখে জ্বালা করতে শুরু করল। সামনের এক দোকান থেকে জল চেয়ে ঝাপটা দিতে তবে রেহাই মিলল। একই অভিজ্ঞতা হলদিয়ার বাসিন্দা অনিমাদেবীরও। কয়েকদিন আগে দু’বছরের ছেলেকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলেন তিনি।

Advertisement

সামসুদ্দিন বিশ্বাস

হলদিয়া শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০১:৩১
Share:

জলে মিশছে কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য। সিটি সেন্টার থেকে দুর্গাচক যাওয়ার পথে (বাঁ দিকে)। সুভাষ সরোবরের কাছে ভ্যাটে উপচে পড়ছে আবর্জনা। ছবি: আরিফ ইকবাল খান

দূষণে জেরবার শিল্পশহর!

Advertisement

বেলা তখন ১১টা। কাজে বেরিয়েছিলেন অশোকবাবু। ধুলোর দাপটে বাড়ি থেকে বেরনোর কিছুক্ষণ পরেই চোখে জ্বালা করতে শুরু করল। সামনের এক দোকান থেকে জল চেয়ে ঝাপটা দিতে তবে রেহাই মিলল। একই অভিজ্ঞতা হলদিয়ার বাসিন্দা অনিমাদেবীরও। কয়েকদিন আগে দু’বছরের ছেলেকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলেন তিনি। কিছুটা পথ এগোতেই বিপত্তি। রাস্তার দু’ধারের জমা জলের দুর্গন্ধে ত্রাহি ত্রাহি রব। শুধু পথে নয়, দূষণের জ্বালা থেকে রেহাই মিলছে না ঘরেও। ‘‘ঘরের জানালা খুললেই ধূলোয় টেকা দায় হয়ে ওঠে’’, মত হলদিয়ার আরেক বাসিন্দা সঞ্জীব দাসের। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘ক্রিটিক্যালি পলিউটেড এরিয়া’ হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে দূষণের জেরে বাড়ছে শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রবণতাও।

নিয়মের তোয়াক্কা না করে খোলা অবস্থায় কয়লা ও সালফার বোঝাই গাড়ি নিয়ে যাওয়ার ছবি চোখে পড়বে। গাড়ি থেকেই বাতাসে মিশছে বিষ। সিটি সেন্টার থেকে এইচপিএল লিঙ্ক রোড ধরে এগোলে রাস্তার দু’ধারের নিকাশি নালার জলের দুর্গন্ধে পথচলাই দায় হয়ে ওঠে।

Advertisement

হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের দূষণ চিত্র আরও করুণ। ‘‘শিল্পাঞ্চলে দূষণের মাত্রা পরিমাপ করতে যন্ত্রের প্রয়োজন নেই। মাস্ক ছাড়া রাস্তায় ঘুরলে যে কেউ টের পাবেন দূষণ কতটা বেশি’’, বলছেন হলদিয়ার দুর্গাচকের বাসিন্দা দেবপ্রসাদ মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘সিটি সেন্টার মোড় থেকে এইচপিএল লিঙ্ক রোড ধরে দুর্গাচকের মঞ্জুশ্রীর দিকে এগোলেই দুর্গন্ধ নাকে আসবে। পুকুরের জলেও কালো রঙের আস্তরণ পড়ে গিয়েছে।’’

হলদিয়ার রানিচকে বন্দরের ঢিল ছোড়া দূরত্বে রয়েছে হলদিয়া গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন। স্কুলের শিক্ষিকা অনন্যা ভট্টাচার্য এইচপিএল লিঙ্ক রোড ধরে স্কুলে আসেন। তাঁর কথায়, ‘‘ঘরের জানালা খোলা রাখলেই আসবাবপত্রে কালো ধুলোর আস্তরণ পড়ে যায়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘দূষণের জেরে ছাত্রছাত্রীরাও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সকলের এগিয়ে আসা উচিত।’’

শিশু বিশেষজ্ঞ আর এন জানা হলদিয়ায় বিগত ১০ বছর ধরে চিকিৎসা করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘দূষণের জেরে সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে চর্ম রোগের প্রবণতা বাড়ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘উপকূলীয় এলাকায় হওয়ার কারণে শহরের বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি। ফলে কারখানা থেকে নির্গত কার্বন বায়ুমণ্ডলের বেশি উঁচুতে উঠতে পারে না। যার জেরে সমস্যা আরও বাড়ে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাধারণত শিল্প কারখানা থেকে ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে বসত বাড়ির গড়ে ওঠা উচিত। তবে হলদিয়ায় কারখানা থেকে দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যেই বাড়ি রয়েছে। ফলে দূষণের প্রভাব বেশি পড়ছে।’’

দূষণের মাত্রা অধিক হওয়ায় ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রক হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০১৩ সালে অবশ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় পরিবেশ মন্ত্রক। ‘হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ’ (এইচডিএ)-র চেয়ারম্যান তথা তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী জানান, বিগত সরকারের আমলে ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় দূষণ পর্ষদ নতুন কারখানা তৈরি বা সম্প্রসারণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তেলের পাইপলাইন লিক করার ফলে নিকাশি নালার জলের সঙ্গে তেল মিশে যাওয়ার মতো কিছু বিষয় নিয়ে পর্ষদ কড়া বার্তাও পাঠায়। শুভেন্দুবাবুর কথায়, ‘‘বর্তমানে আইওসি পাইপলাইনগুলিকে আরও ভাল করায় নিকাশি নালার জলে তেল মিশে যাওয়ার মতো বিষয়গুলি বন্ধ হয়েছে। ২০১৩ সালে পর্ষদ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারও করে নিয়েছে।’’ তিনি আরও জানান, কারখানাগুলি থেকে গন্ধ বেরনোর ফলে মানুষের কিছু সমস্যা হয়। শিল্পসংস্থাগুলিকে গাছ লাগানোর পাশাপাশি দূষণ নিয়ন্ত্রণে আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

হলদিয়া পুরসভার চেয়ারম্যান দেবপ্রসাদ মণ্ডল জানান, দূষণ কমাতে শহরে গাছ লাগানো হচ্ছে। ঝিকুরখালিতে নদীর পাড়ে বন দফতর ম্যানগ্রোভ গাছ লাগিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘কয়লা-সহ বিভিন্ন দূষণ সৃষ্টিকারী পণ্য যাতে গাড়িতে ঢাকা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সে বিষয়ে বিভিন্ন শিল্প সংস্থাকে জানিয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন