সাপের ছোবলে মৃত্যু এড়াতে শিবির

সন্ধেবেলায় ঝোপঝাড়ে ঘেরা নলকূপ থেকে জল তুলতে গিয়ে খরিশের লেজে পা দিয়েছিলেন বছর বত্রিশের এক মহিলা। মুহূর্তে ফণা উঁচিয়ে তাঁর পায়ে ছোবল বসায় সাপটি। আর্ত চিত্‌কারে ভিড় জমে যায়। প্রথমে পরিজনেরা সর্পদষ্টকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি। অনেক পরে নিয়ে যান। ততক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ওই মহিলা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১৪
Share:

সন্ধেবেলায় ঝোপঝাড়ে ঘেরা নলকূপ থেকে জল তুলতে গিয়ে খরিশের লেজে পা দিয়েছিলেন বছর বত্রিশের এক মহিলা। মুহূর্তে ফণা উঁচিয়ে তাঁর পায়ে ছোবল বসায় সাপটি। আর্ত চিত্‌কারে ভিড় জমে যায়। প্রথমে পরিজনেরা সর্পদষ্টকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি। অনেক পরে নিয়ে যান। ততক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ওই মহিলা।

Advertisement

এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরে। সর্পদষ্ট হয়ে যাঁরা মারা যান, তাঁদের একটা বড় অংশ দেরিতে হাসপাতালে আসেন। ফলে, ঠিকঠাক চিকিত্‌সার সুযোগ থাকে না। যাঁরা সময়ে হাসপাতালে আসেন তাঁদের সকলের চিকিত্‌সাও ঠিকঠাক ভাবে হয় না। কিছু ক্ষেত্রে ফাঁক থেকে যায়।

সর্পদষ্টদের চিকিত্‌সায় এই সব ফাঁকফোঁকর যাতে না থাকে সে জন্যই এ বার চিকিত্‌সকদের প্রশিক্ষণ শিবির শুরু হল পশ্চিম মেদিনীপুরে। বৃহস্পতিবার মেদিনীপুর এবং খড়্গপুরে এই শিবিরে মেডিক্যাল অফিসারদের (এমও) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ দেন বিশেষজ্ঞ চিকিত্‌সক দয়ালবন্ধু মজুমদার। মেদিনীপুরের শিবির হয় জেলা স্বাস্থ্য ভবনের সভাঘরে। ছিলেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা, উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর ষড়ঙ্গী, রবীন্দ্রনাথ প্রধান প্রমুখ। খড়্গপুরে শিবির হয় মহকুমা হাসপাতালের সভাঘরে। সর্পদষ্টদের চিকিত্‌সার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। সর্পদষ্ট রোগী হাসপাতালে এলে প্রথমে কী করণীয়, তারপর কী কা করতে হবে, সেই সব বিশদে আলোচনা হয়। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা বলেন, “বর্ষায় জেলার কিছু এলাকায় সাপের উপদ্রব বাড়ে। কখনও কখনও সর্পদষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। এমও-দের নিয়ে শিবিরে সর্পদষ্টদের চিকিত্‌সার বিভিন্ন দিক নিয়েই আলোচনা হয়েছে।”

Advertisement

পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিম মেদিনীপুরে সর্পদষ্টের সংখ্যা এবং সর্পদষ্টে মৃত্যুর সংখ্যা, কোনওটাতেই রাশ টানা যায়নি। ২০০৯ সালে জেলায় ৭০১ জন সর্পদষ্ট হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল দু’জনের। ২০১৪ সালে ৬২১ জন সর্পদষ্টের মধ্যে এক জনের মৃত্যু হয়। আর ২০১৫ সালে ৬৯৮ জন সর্পদষ্ট হন। চার জনের মৃত্যু হয়। জেলার এক স্বাস্থ্য-কর্তা মানছেন, “এখনও গ্রামাঞ্চলে সচেতনতার অভাব রয়েছে। কেউ সর্পদষ্ট হলে পরিবারের লোকজন আগে ওঝার কাছে যান। অনেক পরে হাসপাতালে আসেন। তখন চেষ্টা করেও রোগীকে বাঁচানোর উপায় থাকে না।”

জেলা স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, সর্পদষ্টের সংখ্যা কমাতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি হয়। গ্রামবাসীদের জানানো হয়, এমন ঘটনা এড়াতে কী করা উচিত। যেমন এক স্বাস্থ্য-কর্তার পরামর্শ, বিকেলের পরে বাড়ির বাইরে বেরোলে হাতে টর্চ রাখা দরকার। জুতো পরার আগে সেই জুতো দেখে নেওয়া উচিত। বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখা উচিত। দরজার কাছে লতানো গাছ না রাখাই ভাল। ওই গাছে সাপ জড়িয়ে থাকলে তা বোঝা যাবে না। সব সময় খাটে ঘুমনো উচিত, খালি মেঝেতে নয়। জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রবীন্দ্রনাথ প্রধান বলেন, “সাহস হারালে চলবে না। সাপ ছোবল মারলেও সাহস রাখতে হবে। হাসপাতালে এসে চিকিত্‌সা করাতে হবে। দেরিতে হাসপাতালে এলেই সমস্যা।”

তিনি আরও জানান, সব সাপ বিষাক্ত নয়। সাধারণত যে সব সাপ ছোবল মারে তার ৭০ শতাংশই বিষাক্ত নয়। আবার যে ৩০ শতাংশ বিষাক্ত, তারমধ্যে ৫০ শতাংশ সাপ বিষ ঢালতে পারে না। বাকি ৫০ শতাংশ সাপ বিষ ঢালতে পারে। সর্পদষ্টদের সময় মতো এভিএস দেওয়া দরকার বলেও জানান রবীন্দ্রনাথবাবু। তাঁর কথায়, “আমরা যদি একটু সতর্ক ভাবে চলাফেরা করি, তাহলেই সাপের ছোবল এড়ানো সম্ভব।”

পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে ফি বছর ২ লক্ষ মানুষ সর্পদষ্ট হন। এরমধ্যে ৩৫- ৫০ হাজার মানুষ মারা যান। এরমধ্যে বিষাক্ত নয়, এমন সাপ ছোবল মারে ৮১ শতাংশ মানুষকে। বাকি ১৯ শতাংশ মানুষকে ছোবল মারে বিষাক্ত সাপ। অন্যদিকে, এ দেশে বছরে গড়ে ২০ হাজার মানুষ সর্পদষ্ট হয়ে মারা যান। এর মধ্যে বিষাক্ত নয়, এমন সাপ ছোবল মারে ৭৮ শতাংশ মানুষকে। বাকি ২২ শতাংশ মানুষকে ছোবল মারে বিষাক্ত সাপ। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মূলত বাঁকুড়া, বর্ধমান, নদিয়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি এলাকায় সাপের উপদ্রব বেশি। ২০১১ সালে যেমন বাঁকুড়ায় ৫৫ জন সর্পদষ্ট হয়ে মারা যান। বর্ধমানে ৪৮ জন, নদিয়ায় ৬৭ জন, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ৩৮ জন সর্পদষ্ট হয়ে মারা যান। চিকিত্‌সকদের প্রশিক্ষণ শিবিরের পর জেলায় সর্পদষ্টের মৃত্যুর সংখ্যা কমে কি না, সেটাই দেখার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন