সরলেন দীপক, দায়িত্বে এ বার তরুণ

বিদায়ী জন পরিচিত ছিলেন ‘চরমপন্থী’ হিসেবে। আর নতুন যিনি এলেন তিনি তুলনায় অনেকটাই ‘নরম’। তবে খারাপ সময় দেখেছেন। তাই কঠিন সময়ে জেলায় দলের দায়িত্ব নিয়েও আত্মবিশ্বাসী সিপিএমের নব-নির্বাচিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক তরুণ রায়। রাজ্যে পালাবদলের পরই কঙ্কাল-মামলায় নাম জড়িয়েছিল কেশপুরের কৃষক নেতা তরুণবাবুর। প্রায় দু’বছর আত্মগোপন করে ছিলেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৫৫
Share:

সুশান্ত ঘোষের সঙ্গে বিদায়ী জেলা সম্পাদক দীপক সরকার।

বিদায়ী জন পরিচিত ছিলেন ‘চরমপন্থী’ হিসেবে। আর নতুন যিনি এলেন তিনি তুলনায় অনেকটাই ‘নরম’। তবে খারাপ সময় দেখেছেন। তাই কঠিন সময়ে জেলায় দলের দায়িত্ব নিয়েও আত্মবিশ্বাসী সিপিএমের নব-নির্বাচিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক তরুণ রায়।

Advertisement

রাজ্যে পালাবদলের পরই কঙ্কাল-মামলায় নাম জড়িয়েছিল কেশপুরের কৃষক নেতা তরুণবাবুর। প্রায় দু’বছর আত্মগোপন করে ছিলেন। পরে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পান। মঙ্গলবার নতুন দায়িত্ব পাওয়ার দিনেও তাই তাঁর মুখে লড়াইয়ের কথা। বললেন, “আমাদের লড়াই মানুষের জন্য। গরিব মানুষের জন্য। এ জন্য সব গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতেই হবে।”

একদা ‘লালদুর্গ’ পশ্চিম মেদিনীপুরে গত বিধানসভা ভোট থেকেই সিপিএমের বিপর্যয় শুরু। এরপর একে একে পঞ্চায়েত নির্বাচন, পুর-নির্বাচনে দলকে ধাক্কা খেতে হয়েছে। লোকসভা ভোটেও বামেদের নজিরবিহীন ভরাডুবি হয়েছে। এই অবস্থায় জেলায় দলকে দাঁড় করানোর চ্যালেঞ্জটা কঠিন নয়? তরুণবাবুর দৃঢ় জবাব, “প্রতিকূল পরিবেশেই কমিউনিস্টরা কাজ করেন।”

Advertisement

দলের সমর্থক, সর্বক্ষণের কর্মী থেকে জেলার শীর্ষ পদ পথটা আদৌ মসৃণ ছিল না তরুণবাবুর কাছে। প্রয়াত সুকুমার সেনগুপ্তের সূত্রেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সেটা ষাটের দশকের শেষ দিক। ঘনিষ্ঠ মহলে এখনও বলেন, “সুকুমারদার কাছে অনেক কিছু শিখেছি।” তরুণবাবুর বাড়ি কেশপুরের মহিষদায়।

নতুন সম্পাদক তরুণ রায়।

এই গ্রামেই বাড়ি তৃণমূলের তারকা সাংসদ দেবের। তরুণবাবু মহিষদা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। পরে চাকরি ছেড়ে দলের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। গোড়া থেকেই তিনি কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে। ১৯৭৮ থেকে বছর দেড়েক কেশপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলেন। পরে কেশপুর ছাড়িয়ে জেলা রাজনীতিতে তাঁর পরিচিতি বাড়ে। প্রথমে জেলা কমিটির সদস্য, পরে দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। দলের রাজ্য কমিটিরও সদস্য তিনি। ২০১০ সালে সিপিএমের কৃষক সংগঠন কৃষকসভার রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন তরুণবাবু।

১৯৯২ সাল থেকে একটানা জেলা সম্পাদকের পদে ছিলেন দীপক সরকার। তাঁরই স্থলাভিষিক্ত হলেন তরুণবাবু। একটা সময় দলের অন্দরে এই দু’জনের অবস্থান ছিল একেবারে ভিন্ন মেরুতে। ২০০৫ সালে চন্দ্রকোনা রোড সম্মেলনের পর থেকে। ওই সম্মেলনে জেলা সম্পাদকের পদ নিয়ে দীপক সরকারের সঙ্গে তরুণ রায়ের লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। শেষমেশ তত্‌কালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস পরিস্থিতি সামাল দেন। জেলা সম্পাদক পদে থেকে যান দীপকবাবু। জেলার রাজনীতিতে দীপকবাবুর একচ্ছত্র আধিপত্য সত্ত্বেও দলের অন্দরে ছিল বিরোধ। একটা সময় সূর্যকান্ত মিশ্র, তরুণ রায়, লক্ষ্মণ শেঠদের সঙ্গে দীপকবাবুর ঘনিষ্ঠতাই ছিল। পরে দীপক-অনুগামী এবং সূর্য-অনুগামীদের বিরোধ বাড়ে। দলের এক সূত্রের দাবি, জেলায় নিজের ‘নিয়ন্ত্রণ’ রাখতে এক সময় সূর্যবাবুকে মন্ত্রী করে রাজ্যে পাঠাতে কম ‘তদারকি’ করেননি দীপকবাবু। সূর্যবাবু ১৯৯১ সালের বিধানসভা ভোটে নারায়ণগড় থেকে নির্বাচিত হন। মন্ত্রিত্বও পান। মন্ত্রী হয়ে সূর্যবাবু রাজ্য-রাজনীতিতে পা রাখার পর জেলা রাজনীতিতে হয়েছেও ঠিক তাই।

যত দিন গিয়েছে, ততই একঘরে হয়েছেন সূর্য-শিবিরের অনুগামী বলে পরিচিতরা। দলের অন্দরে তরুণবাবু সূর্য-অনুগামী বলেই পরিচিত। সেই দীপকবাবুই এদিন এই কৃষক নেতার নাম নতুন জেলা সম্পাদক পদে প্রস্তাব করেন। সর্বসম্মতিক্রমে সিপিএমের জেলা সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন তরুণবাবু। তরুণবাবুর এই অভিষেকপর্বে উপস্থিত ছিলেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে বিপর্যয়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ানোর কাজ শুরু করেছে সিপিএম। এখন তরুণবাবু সংগঠনে কতটা ঝাঁকুনি দিতে পারেন, সেটাই দেখার।

তরুণ-অনুগামীরা অবশ্য আত্মবিশ্বাসী, সামনের চড়াই- উতরাই পথটাও তিনি অনায়াসে পেরোবেন।

ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

বাদ ২০ জন, গুরুত্ব নতুনদের

এক ধাক্কায় সিপিএমের জেলা কমিটি থেকে বাদ গেলেন ২০ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ঝাড়গ্রামের প্রাক্তন সাংসদ রূপচাঁদ মুর্মু। সিপিএম নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, ওই ২০ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার মেদিনীপুরে শেষ হয় সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্মেলন। সম্মেলন থেকে ৭০ জনের নতুন জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বাদে ৬ জন বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য রয়েছেন। বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন মন্ত্রী নন্দরানি ডল। জেলা কমিটিতে নতুন সদস্য এসেছেন ২২ জন। জায়গা পেয়েছেন যুব সংগঠন ডিওয়াইএফ-এর জেলা সম্পাদক দিলীপ সাউ, এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক সৌগত পণ্ডা প্রমুখ। আছেন প্রাক্তন যুব নেতা সুদীপ্ত সরকারও। সুদীপ্ত সিপিএমের বিদায়ী জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের পুত্র। শুধু তাই নয়, জেলবন্দি নেতা-নেত্রীও ঠাঁই পেয়েছেন সিপিএমের জেলা কমিটিতে। অবশ্য আগে থেকেই তাঁরা দলের জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। কমিটিতে থেকে গিয়েছেন অনুজ পাণ্ডে, ফুল্লরা মণ্ডল। দু’জনই নেতাই মামলায় অভিযুক্ত। এখন জেলে রয়েছেন। কমিটিতে থেকে গিয়েছেন গড়বেতার নেতা তপন ঘোষ, সুকুর আলিও। সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, দলের যাঁরা জেলে রয়েছেন, মিথ্যা মামলাতেই তাঁদের জড়ানো হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন