মা যখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, বাবা ছেড়ে চলে যান। সেই সন্তানকে শেষ পর্যন্ত জন্ম দেন মা। মেয়েটি এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। পিতৃপরিচয় নেই বলে কন্যাশ্রীর টাকা জুটছে না তার। অভিযোগ, সেই নিয়ে বলতে গিয়ে উল্টে জুটেছে ‘অবৈধ সন্তান’ বলে গালমন্দ। তবে তাতে হতোদ্যম না হয়ে পড়েনি মা-মেয়ে। লড়াই গড়িয়েছে হাইকোর্ট অবধি। তার পরেই আদালতের ধাক্কায় সক্রিয় হয়েছে প্রশাসন। ছাত্রীর বাড়ি এসে বয়ান নিয়েছেন বিডিও অফিস এবং পুলিশ অফিসারেরা। স্কুল কর্তৃপক্ষকে শো-কজ করার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।
লড়াই শুধু একা মেয়ের নয়। দেড় দশক ধরে আদালতে লড়াই চালাচ্ছেন ছাত্রীর মা। জলপাইগুড়ির বেলাকোবায় থাকেন তিনি। চোদ্দো বছর আগে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর সঙ্গে সহবাসের অভিযোগ ওঠে স্থানীয় এক যুবকের। অভিযুক্ত শেষে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ওই মহিলা অভিযোগ দায়ের করেন। কয়েক মাস পরে তাঁর সন্তান জন্ম নেয়। এখন সেই মেয়েও তাঁর লড়াইয়ের অংশীদার।
ক্লাসের আর পাঁচটা মেয়ে যখন শিক্ষাশ্রী, কন্যাশ্রীর টাকা পাচ্ছে, তখন ওই মেয়ের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। তার আবেদনই নিতে চাননি স্কুল কর্তৃপক্ষ। ছাত্রীটি বলেছে, ‘‘বাবার থেকে সই আনতে বলেছে স্কুল। কিন্তু বাবা তো আমাকে মেয়ে হিসেবে স্বীকারই করতে চায় না!’’
কন্যাশ্রীর মতো সরকারি প্রকল্পের অনুদান পেতে গেলে কি বাবার পরিচয় বাধ্যতামূলক? মেয়েটি যে স্কুলে পড়ে, তার প্রধান শিক্ষিকা মানসী ঠাকুর বলেন, ‘‘বাবার সই বা নথি ছাড়া প্রকল্পের সুবিধে দিতে সমস্যা হয়। তাই সমস্যা হয়েছিল। বিডিও অফিস থেকে কাগজ তৈরি করে আনলে প্রকল্পের সুবিধে দেওয়া যেতেই পারত।’’ কিন্তু সুপ্রিম কোর্টই তো বলেছে, বাবা বা মা, যে কোনও এক জনের পরিচয়ই যথেষ্ট সন্তানের ক্ষেত্রে। ছাত্রীটি নিজেও বলেছে, ‘‘ফর্মের পেছনে লেখা নিয়ম পড়ে দেখেছি। বাবার সই লাগবেই, এমন কথা বলা নেই।’’ তার অভিযোগ, ‘‘সে কথা বলতে গেলে উল্টে আমাকে ‘অবৈধ সন্তান’ বলে গালমন্দ করা হয়েছে।’’
শিক্ষকদের একাংশ অবশ্য বলছেন, বিডিও অফিস এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ সক্রিয় হলেই ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে ছাত্রীর নামে অ্যাকাউন্ট খুলে ভাতা দেওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ছাত্রীর যে কোনও অভিভাবকের নাম জানিয়ে পরিচয়পত্র জমা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা যেত।
কিন্তু হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার পরেই পরিস্থিতি বদলে যায়। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জায়গায় শিশুদের অধিকার থেকে বঞ্চনার বেশ কয়েকটি অভিযোগ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে নালিশ জানিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লিগাল এড ফোরামের সম্পাদক অমিত সরকার। তিনি বলেন, ‘‘ছাত্রীটি কিন্তু শুধু টাকা চায়নি। ও অধিকারের জন্য লড়াই চালাচ্ছে। সেটা জেনেই হাইকোর্টে মামলা করেছিলাম।’’
রাজ্যের বিরুদ্ধে সেই মামলায় গত ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতী নিশিথা মাত্রে এবং বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ সব ক’টি অভিযোগে প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা হলফনামা দিয়ে জানানোর নির্দেশ দেন। তার পরেই সরকারি স্তরে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে ছাত্রীর বাড়িতে। হাইকোর্টের আইনজীবী মধূসূদন সাহারায় বলেন, ‘‘অভিযোগ শুনে হাইকোর্ট উষ্মা প্রকাশ করেছিল। শিশু অধিকার রক্ষায় প্রশাসন কী করছে, তা জানতেই হলফনামা চেয়েছেন ডিভিশন বেঞ্চ। ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’
এখন তাদের বাড়িতে ঘনঘন সরকারি অফিসারদের আনাগোনা। ছাত্রীর মায়ের কথায়, ‘‘হঠাৎ সে দিন রাতে থানা থেকে এসে বয়ান নথিবদ্ধ করে গেল। তার পর এক দিন বিডিও সাহেবও বাড়িতে এলেন।’’ তাঁর আফসোস, ‘‘একটু আগে থেকে চেষ্টা করলে এত দিনে মেয়েটা আমার বৃত্তিটুকু পেয়ে যেত।’’