ভেটকির বিকল্প ফিলে জোগাচ্ছে মোনোপিয়া

পুরো নাম ‘মোনোসেক্স তেলাপিয়া’। প্রথম শব্দের ‘সেক্স’ আর দ্বিতীয় শব্দের ‘তেলা’ বাদ দিয়ে জোড়কলম শব্দে তার আদরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মোনোপিয়া’। প্রকৃত ভেটকি দুর্লভ আর দুর্মূল্য হয়ে ওঠায় ফিলে জোগান দেওয়ার জন্য বিকল্পের ভূমিকা নিচ্ছে এই নতুন মাছ।

Advertisement

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২২
Share:

পুরো নাম ‘মোনোসেক্স তেলাপিয়া’। প্রথম শব্দের ‘সেক্স’ আর দ্বিতীয় শব্দের ‘তেলা’ বাদ দিয়ে জোড়কলম শব্দে তার আদরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মোনোপিয়া’। প্রকৃত ভেটকি দুর্লভ আর দুর্মূল্য হয়ে ওঠায় ফিলে জোগান দেওয়ার জন্য বিকল্পের ভূমিকা নিচ্ছে এই নতুন মাছ।

Advertisement

অবশ্য শুধু ফিলে নয়, ভেটকির বিকল্প হিসেবে আরও কিছু পদে রীতিমতো উপযোগী হয়ে উঠছে মোনোপিয়া। বাসা-র মতো মেছো গন্ধহীন মাছ নয়। এটা খেতে মাছ-মাছই। যার পাতুরি, ভাপা, চিলিফিশ, ফিশফিঙ্গার, টোম্যাটো ফিশের মতো কিছু রসালো পদ সুস্বাদু। মধ্যবিত্ত বাঙালি এই মাছেই পেয়ে গিয়েছে সাধ্যের মধ্যে স্বাদপূরণের হদিস।

তাই বাড়ছে মোনোপিয়ার চাহিদা। এবং সেই চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পটভূমিটাও বেশ চমকপ্রদ। এ বার বিয়ের মরসুমে বেজায় সমস্যায় পড়েছিলেন কেটারার এবং অনুষ্ঠান বাড়ির আয়োজকেরা। নোট বাতিলের জেরে ভিন্‌ রাজ্য থেকে দেশি ভেটকি, বম্বে ভেটকি, ভোলা ভেটকির আমদানি থমকে গিয়েছিল। খাঁটি বঙ্গজ ভেটকির উৎপাদন হাজারো অনুষ্ঠানবাড়ির চাহিদা মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। আবার শরীরগত কারণে তাতে ফিলেও বেরোয় কম। বাইরে থেকে ভেটকির আগমন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই রাজ্যে উৎপাদিত ভেটকির দাম বেশ চড়া ছিল। একটা সময়ে তো ফিলের দাম কেজি-প্রতি ১২০০ টাকা ছুঁয়ে ফেলেছিল।

Advertisement

অগত্যা বিকল্প ফিলে দেওয়ার জন্য একটি মাছকে বেছে নেওয়া হয় এবং সেটিই মোনোপিয়া। গোত্রপরিচয়ে তেলাপিয়া প্রজাতির। চেনাজানায় খামতি থাকলে অনেকেই তেলাপিয়া কিনতে গিয়ে নাইলনটিকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। রীতিমতো গবেষণা করে একটু অন্য চেহারায় হাজির করা হচ্ছে তাকেই। তেলাপিয়া প্রজাতির নাইলনটিকা মাছকে জিনগত ভাবে উন্নত করে শুরু হয়েছে মোনোপিয়ার চাষ। এক-একটি মাছ ওজনে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। বাড়ে তরতরিয়ে। মোনোপিয়ার ওজন মাস আটেকের মধ্যে এক কেজি ছাড়িয়ে যায়। পিঠের দিকটা বেশ মাংসল। তাই ফিলে মেলে ভাল পরিমাণে।

চেখেছেন যাঁরা, তাঁরা জানাচ্ছেন, বাসা তো বটেই, ভোলা-ভেটকির চেয়েও এই মাছের ফিলের স্বাদ বেশি। চক্রবেড়িয়া তল্লাটের এক কেটারিং সংস্থার ম্যানেজার রানা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মোনোপিয়ায় ভাল ফিশফ্রাই হয়তো হবে না। তবে পাতুরি বা ভাপার মতো সর্ষে দিয়ে রাঁধা পদ, চিলিফিশ, টোম্যাটো ফিশ, ছোট ফিশফিঙ্গার এবং উৎকৃষ্ট মানের চপ তৈরি করা যাবে এই মাছ দিয়ে।’’

সাশ্রয় হচ্ছে দামেও। বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ, কেটারারকে মাছের ফিলে সরবরাহ করেন দমদমে গোরাবাজারের মাছ ব্যবসায়ী তারক দাস। তাঁর কথায়, ‘‘মোনোপিয়ার ফিলে অন্য যে-কোনও মাছের তুলনায় অনেক সস্তা। অথচ বাসা বা বিলিতি পাঙাসের মতো এই মাছ গন্ধহীন নয়। স্বাদ যথেষ্টই ভাল।’’

এখন শীতকাল। ভেটকির মরসুম। তবু খুচরো বাজারে এক কেজি ওজনের তাজা ভেটকির দাম ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। মৎস্য দফতরের খবর, বড় সাইজের মোনোপিয়া মিলবে ২০০ টাকার কমে (প্রতি কেজি)। অর্থাৎ ফিলের দাম দাঁড়াচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা।

সব দিক থেকেই উপযোগী। তবে জিন-প্রযুক্তিতে কৃত্রিম ভাবে বাড়িয়ে তোলায় মনুষ্যশরীরে মোনোপিয়ার প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছিল। মিন অবস্থায় জলাশয়ে মোনোপিয়া ছাড়ার পরে প্রথম ২১ দিন তাদের হরমোন খাওয়ানো হয়। সেটাই তাদের হৃষ্টপুষ্ট হওয়ার কারণ। হরমোনলালিত সেই মাছ খেলে মানুষের শরীরে কোনও সমস্যা হতে পারে কি? অভয় দিচ্ছেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, শৈশবে খাওয়া হরমোন মাছ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। আর সেই জন্যই এই মাছে কোনও বিপদ নেই। পরীক্ষায় ইতিমধ্যে সেটা প্রমাণিতও হয়েছে।

অতএব মোনোপিয়ার সামনে ফাঁকা ময়দান। রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, ‘‘শুধু এ দেশে নয়, মোনোপিয়ার ফিলের চাহিদা বাড়ছে বিদেশের বাজারেও। সাধারণ তেলাপিয়ার থেকে মোনোপিয়ার উৎপাদনের হার অনেক গুণ বেশি। দ্রুত বাড়ে। চাষি আর্থিক দিক থেকে অনেকটাই লাভবান হবেন‌।’’ মন্ত্রী জানান, একটি বেসরকারি সংস্থা মোনোপিয়ার ফিলে প্রক্রিয়াকরণের কারখানা গড়ছে হুগলিতে। বিদেশে ফিলে রফতানি করবে তারা। হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর-সহ কয়েকটি জেলায় মৎস্য দফতরের উদ্যোগে মোনোপিয়ার চাষ শুরু হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন