বিস্ফোরক হোক বা মাদক। খুনি হোক বা ধর্ষক। অন্তরালে থাকা বিবিধ বিপদের পর্দা ফাঁস করতে এদের জুড়ি নেই। প্রশিক্ষিত কুকুরেরা তাই যে কোনও পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর বড় সম্পদ। যে কারণে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যে ডগ স্কোয়াডের সংখ্যা বাড়াতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে সাতটি ডগ স্কোয়াড রয়েছে। স্থির হয়েছে, আরও ১৫টি স্কোয়াড গড়ে তোলা হবে।
পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গিদের আনাগোনা থাকলেও তারা এখানে নাশকতা ঘটানোর কথা ভাবে না গোয়েন্দা মহলে দীর্ঘ কাল ধরে এমন একটা ধারণাই চালু ছিল। কিন্তু গত ক’বছরে তা অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। গোয়েন্দারা সম্প্রতি জানতে পেরেছেন, জঙ্গি গোষ্ঠী ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম) একাধিক বার পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে হামলার ছক কষেছে, যদিও তাদের সে ছক শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বস্তুত এ রাজ্য যে বিলক্ষণ জঙ্গি-নিশানার আওতায়, সম্প্রতি বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
এমতাবস্থায় সম্ভাব্য উগ্রপন্থী হামলা ও নাশকতার মোকাবিলায় প্রায় প্রতি জেলায় ডগ স্কোয়াড তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র দফতর। প্রসঙ্গত, রাজ্যে এখন যে সাতটি সারমেয়-বাহিনী, তার চারটেই রেল-পুলিশের শিলিগুড়ি, হাওড়া, শিয়ালদহ ও খড়্গপুর স্টেশনে মোতায়েন। এ ছাড়া কলকাতা শিলিগুড়ি ও ব্যারাকপুর কমিশনারেটে রয়েছে তিনটি স্কোয়াড। এ বার ১২টি জেলার সদর ছাড়াও হাওড়া, বিধাননগর ও আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটে একটি করে ডগ স্কোয়াড রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। রাজ্য পুলিশের কর্তারা জানাচ্ছেন, বেশি দূরে নিয়ে গিয়ে কাজ করালে কুকুরেরা তা পছন্দ করে না। সে কারণেই রাজ্য জুড়ে অনেকগুলো ডগ স্কোয়াড করার পরিকল্পনা, যাতে কোনও ঘটনা ঘটলে সারমেয়-বাহিনী দ্রুত পৌঁছে যেতে পারে।
ঠিক হয়েছে, নতুন ১৫টি ডগ স্কোয়াডের প্রতিটায় আপাতত দু’টো কুকুর থাকবে, যাদের আলাদা আলাদা রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। একটার কাজ হবে বিস্ফোরকের খোঁজ দেওয়া (এক্সপ্লোসিভ ডিটেক্টর)। অন্যটি দেখাবে, অপরাধী পালিয়েছে কোন পথে (ক্রাইম ট্র্যাকার)। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “সাধারণত ডগ স্কোয়াডে অন্তত ছ’টা কুকুর থাকা উচিত। সংখ্যাটা পঞ্চাশের উপরেও নিয়ে যাওয়া যায়। তবে এখানে এখনই তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে চেষ্টা হচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতি স্কোয়াডে অন্তত ছ’টি কুকুর দেওয়া যায়।”
নতুন স্কোয়াডের কুকুর মিলবে কোথা থেকে?
পুলিশ-সূত্রে জানা গিয়েছে, কিছু কুকুর নেওয়া হবে রাজ্য পুলিশের ব্যারাকপুর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে। তার পরেও গোটা ছাব্বিশেক বাচ্চা কিনতে হবে। এক-একটার দাম পড়বে ২০-২৫ হাজার টাকা। স্বরাষ্ট্র-সূত্রের খবর, এ বাবদ অর্থ দফতর ইতিমধ্যে ৫০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছে। পুলিশের কাজে কী ধরনের কুকুর নেওয়া হয়?
কলকাতা পুলিশের ডগ স্কোয়াডের প্রধান প্রদীপ পাণ্ডে জানাচ্ছেন, বিস্ফোরক তল্লাশ ও অপরাধী সন্ধান আগে দু’টোর জন্যই চনমনে এবং উগ্র স্বভাবের কুকুর রাখা হতো। যাতে তারা লক্ষ্যবস্তুর আঁচ পেলেই চেঁচিয়ে নজর কাড়তে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুষ্কর্মের আধুনিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে এই নিয়মও কিছুটা বদলে গিয়েছে। কী রকম?
প্রদীপবাবুর ব্যাখ্যা, “ইদানীং অনেক বোমায় সাউন্ড সেন্সর লাগানো থাকছে। কুকুর কাছাকাছি গিয়ে চিৎকার করলে বোমা ফেটে যেতে পারে। মানে উল্টো বিপদ।” তাই ওই কাজে এখন ল্যাব্রাডর রিট্রিভার, গোল্ডেন রিট্রিভার বা ককার স্প্যানিয়েলের মতো তুলনায় ধীর স্বভাবের কুকুর ওঁরা বেশি চাইছেন। অপরাধী পাকড়াতে অবশ্য অ্যালসেশিয়ানই পুলিশের পছন্দ-তালিকার শীর্ষে।
লালবাজারের খবর, অদূর ভবিষ্যতে কলকাতা পুলিশের ডগ স্কোয়াডে ‘সার্চ ডগ’ও রাখা হবে। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষের হদিস পেতে এরা খুব কার্যকর। উগ্রপন্থী কবলিত অঞ্চলে অভিযান চালাতে বিশেষ ধরনের ‘গার্ড অ্যাসল্ট’ কুকুর ব্যবহার করা হয়। তাদের গায়ে ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন লাগানো থাকে। ক্যামেরায় জঙ্গিদের উপস্থিতি ধরা পড়ে, আর মাইক্রোফোন মারফত কুকুরকে নির্দেশ দেন ট্রেনারেরা।
এনএসজি বা মুম্বইয়ের সন্ত্রাসদমন শাখার কাছে এমন কুকুর থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের হাতে এখনও গার্ড অ্যাসল্ট ডগ নেই। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ যে ভাবে মাথা তুলছে, তাতে গার্ড অ্যাসল্টের প্রয়োজন কলকাতার পড়তেই পারে বলে মনে করছে লালবাজারের একাংশ।