নিথর ছেলেকে ফেরাবে এভারেস্ট, আশায় মা

কিছুই নেয় না সমুদ্র। সবই ফিরিয়ে দেয়। পাহাড় কি দেয় না? পাহাড়ের রাজা হিমালয় কি অন্তত ফিরিয়ে দেবে না?

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৭ ০৩:২৬
Share:

কিছুই নেয় না সমুদ্র। সবই ফিরিয়ে দেয়। পাহাড় কি দেয় না? পাহাড়ের রাজা হিমালয় কি অন্তত ফিরিয়ে দেবে না?

Advertisement

বৃষ্টি নামলেই চমকে চমকে ওঠেন বৃদ্ধা। বিড়বিড় করেন, ‘‘ছেলেটা একা বাইরে ভিজছে যে...!’’ পাহাড়ের উপরে পরম বিশ্বাস থেকে কখনও আবার বলে ওঠেন, ‘‘গত বার দুর্যোগে ফিরতে পারেনি ছেলে। এ বার একেবারে শৃঙ্গ ছুঁয়ে আসবে।’’

৭৫ বছরের বৃদ্ধাকে স্তোক দেওয়ার ভাষা হারিয়েছে পরিবার। তারাও জানে না, ছেলে ফিরবেন কি না। তাদেরও জিজ্ঞাসা, মৃতদেহটুকুও কি ফেরত দেবে না হিমালয়?

Advertisement

ব্যারাকপুরের পর্বতারোহী গৌতম ঘোষকে নিয়ে এমনই অনিশ্চয়তা সম্বল করে দিন গুজরান করছে তাঁর পরিবার। গত বছর এপ্রিলে এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিলেন গৌতম। শৃঙ্গজয়ের কঠিন পথ পার করে ফেরা হয়নি তাঁর। পথেই ফুরিয়েছে জীবন। চতুর্থ শিবির এবং শৃঙ্গের মাঝামাঝি ‘ট্র্যাঙ্গুলার ফেস’-এ দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে তাঁর নশ্বর দেহ, জানিয়েছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী অভিযাত্রী ও শেরপারা। নশ্বর। কারণ, তুষাররাজ্যে বিকৃতি আসে না মৃতদেহে। আবহাওয়া খারাপ হয়ে যাওয়ায় নিথর গৌতমকে নামিয়ে আনা যায়নি গত বছর। দাদা দেবাশিস ঘোষ বললেন, ‘‘প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম, এ বছর নামানো হবে ওকে।’’ দেবাশিসের দুশ্চিন্তা, মার্চ প্রায় শেষ। শীঘ্রই শুরু হয়ে যাবে অভিযানের মরসুম। এখনও সরকারি তরফে কোনও ইঙ্গিতই মিলল না।

স্বামীর দেহটুকু স্পর্শের আশায় দাঁতে দাঁত চেপে সরকারি দফতরের দোরে দোরে ঘুরছেন গৌতমের স্ত্রী চন্দনা। সব জায়গাতেই শুনতে হচ্ছে, ‘অপেক্ষা করুন’। ‘‘কিন্তু আর কত? অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। অথচ গৌতমকে আনার ব্যাপারে কিছুই বলছে না কেউ’’— ক্ষোভ ঝরে পড়ে চন্দনার গলায়।

স্বামীর নিথর দেহের পথ চেয়ে আছেন সবিতা নাথও। দুর্গাপুরের পর্বতারোহী পরেশচন্দ্র নাথের স্ত্রী। গৌতমের খুব কাছাকাছি, একই ভাবে তুষাররাজ্যে চিরঘুমে মগ্ন দুর্গাপুরের বি-জোনে শরৎচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা পরেশ। বছর ঘুরতে চলল, ইতিবাচক ইঙ্গিত দূরের কথা, সরকার যোগাযোগটুকুও করেনি। ‘‘আগের বার উদ্ধারকারী দল বলেছিল, ‘পরের বার ঠিক নিয়ে আসবো দেহ’। বলেছে যখন, তখন নিশ্চয় ওরা কথা রাখবে,’’ গলা বুজে আসে সবিতার।

গৌতম যে-সংস্থার মাধ্যমে এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগ করেও উত্তর মেলেনি বলে অভিযোগ পরিবারের লোকজনের। সরকারের কাছে তাঁরা যত বার গিয়েছেন, তত বারই ফিরতে হয়েছে আশাহত হয়ে।

যুবকল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ শাখার উপদেষ্টা দেবদাস নন্দী জানান, এই বিষয়ে আলোচনা চলছে। ঠিক সময়ে মৃতদের পরিবারকে জানানো হবে। এপ্রিলে লোৎসে শৃঙ্গ অভিযানে যাচ্ছেন পর্বতারোহণ শাখার গভর্নিং বডির সদস্য, পর্বতারোহী দেবাশিস বিশ্বাস। এভারেস্ট ও লোৎসের পথ অনেকটা দূরত্ব পর্যন্ত অভিন্ন। দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘যুবকল্যাণ সচিবকে প্রস্তাব দিয়েছি, অভিযানের সময় শেরপাদের মাধ্যমে খুব কাছ থেকে জানতে পারব, গৌতমদা আর পরেশদার দেহ কী অবস্থায় আছে। যদি নামানোর মতো অবস্থায় থাকে, সরকারকে জানাব। সেই বুঝে উদ্ধারের ব্যবস্থা হবে।’’

তবে ওই গভর্নিং বডিরই এক কর্তা জানাচ্ছেন, এখনও যদি প্রস্তুতি সম্পূর্ণ না-হয়ে থাকে, সে-ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে উদ্ধারকাজ হবে কি না— সেই বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন